রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সামাজিকতার নিষ্ঠুর চেহারা

মাওলানা শিব্বীর আহমদ:
কেউ যদি আন্তরিকভাবে কাউকে উপহার দিতে চায়, কারও আনন্দে শরিক হতে চায়, তাহলে এ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এজন্য আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতা কেন?

বিয়ে-শাদি, আকিকা কিংবা এ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠানে কেউ যখন আমন্ত্রিত হয়, তখন সেখানে কোনো উপহারসহ উপস্থিত হওয়া যেন আমাদের একপ্রকার সামাজিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা দুদিক থেকেই। যিনি আমন্ত্রিত, তিনি ভাবেন- একটি মানসম্মত উপহার ছাড়া সেখানে যাওয়া যাবে না। আবার যারা আমন্ত্রক, তারা অতিথিদের বরণ করার তুলনায় উপহার গ্রহণের প্রতি অধিক মনোযোগী থাকেন। উপহার গ্রহণের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থাপনা। এমন সামাজিকতায় মৌলিকভাবে দুটি ভালো দিক রয়েছে এবং দুটোই ইসলামসমর্থিত। এক. উপহার প্রদান, দুই. অন্যের আনন্দে শরিক হওয়া। উপহার আদান-প্রদানে সামাজিক বন্ধন বাড়ে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে পারস্পরিক এ নেওয়া-দেওয়াটা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় তখন দূর-বহুদূরের কারো সঙ্গে গড়ে ওঠে আত্মার সম্পর্ক। এ সম্পর্ক অনেক সময় ছাড়িয়ে যায় রক্ত ও আত্মীয়তার বাঁধনকেও।

আবার কাছের বা দূরের কোনো আত্মীয় কিংবা কোনো প্রতিবেশী বা বন্ধুর যখন কোনো খুশির উপলক্ষ আসে তখন তার সে আনন্দ ভাগ করে নেওয়াটাও আত্মীয়তা, প্রতিবেশ কিংবা বন্ধুত্বের দাবি। ইসলামের শিক্ষা হলো- কারও বিপদে যেমন পাশে দাঁড়াতে হয়, পাশে থাকতে হয় তার সুখের সময়ও। এটাই সামাজিকতা।

পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ আমাদের আদেশ করেছেন আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী প্রমুখের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকে তার সঙ্গে শরিক করবে না। আর সদাচরণ করো বাবা-মায়ের সঙ্গে এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সঙ্গেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ -সুরা নিসা : ৩৬

এই আয়াতে আমাদের যেমন এক আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হচ্ছে, একই গুরুত্বের সঙ্গে বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের আদেশ করা হচ্ছে। সুন্দর আচরণের সীমা অনেক বিস্তৃত। সুন্দর আচরণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কেউ যখন কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান করে, তখনো সে চায়- তার কাছের সবাইকে নিয়ে সে আনন্দ উদযাপন করবে। আবার তার ঘনিষ্ঠ যারা তারাও আশা করে, তাদের সঙ্গে নিয়েই সে অনুষ্ঠান করবে। একে অন্যের কাছে এটা ঘনিষ্ঠতার দাবি। শরিয়তের নীতি ও বিধান অনুসারে উভয়েরই এ দাবি রক্ষা করা উচিত। কাছের কেউ যখন কোনো আমন্ত্রণে সাড়া না দেয় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না জানায়, তখন আমরা অনুভব করি এর গুরুত্ব।

তাই বিয়ে-শাদিসহ এরকম কোনো অনুষ্ঠানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত কিংবা শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো সংকট না থাকে, তখন ওই আমন্ত্রণ সে রক্ষা করবে- এটাই ইসলামের শিক্ষা।

এ শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও দেখুন। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের পাঁচটি অধিকার- ১. সালামের জবাব দেওয়া, ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, ৩. জানাজায় শরিক হওয়া, ৪. দাওয়াত করলে তা রক্ষা করা, ৫. হাঁচির জবাবে দোয়া পড়া। -সহিহ বোখারি : ১২৪০

আমন্ত্রণ রক্ষা করা কেবল সামাজিকতার দাবি নয়, এটা মুমিনের জন্য ইমানের দাবিও বটে।

অনেকে আবার অসচ্ছলদের দাওয়াতকে পরোয়া করেন না। অথচ নৈতিকতার দাবি হলো, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা কারও দাওয়াতেই অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সাড়া দেওয়া। নবী কারিম (সা.)-এর জীবনাদর্শ আমাদের এটাই শিক্ষা দেয়। তাকে যখন কেউ আমন্ত্রণ করত, তিনি সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। আমন্ত্রণকারী ধনী না গরিব, সচ্ছল না অসচ্ছল, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না কোনো সাধারণ ব্যক্তি- এসব তিনি লক্ষ করতেন না।

এ তো হাদিয়া-উপহার আর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ রক্ষা করার ক্ষেত্রে মৌলিক কথা। কিন্তু আমরা সামাজিকভাবে এ বিষয়টি যেভাবে নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি, এখন তা নিয়ে অবশ্যই ভাবনার অবকাশ আছে। সংকট হলোÑ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে।

বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠান, আকিকার অনুষ্ঠান এ জাতীয় আরও যত অনুষ্ঠান, সেখানে যদি কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, ওই আমন্ত্রণ কেউ কেউ যেমন খুশিমনে গ্রহণ এবং তা সাগ্রহে রক্ষা করে। আবার এই আমন্ত্রণ অনেকের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের অভাবের সংসার, কিংবা যাদের চলতে হয় একটি নির্দিষ্ট আয় দিয়ে, তারা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীর এমন আনন্দ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে যেমন আনন্দিত হয়, পরক্ষণেই আবার দুশ্চিন্তায় ছেয়ে যায় তাদের চেহারা। কারণ সেখানে একটা মানসম্মত ‘গিফট’ দিতেই হবে। সামর্থ্য যতটুকু আছে তাতে মান রক্ষা হয় না। আর মান রক্ষা করতে গেলে নিজের ক্ষমতায় কুলায় না।

আপনজন কারো বিয়েতে বা অন্য কোনো আয়োজনে শরিক না হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই, আবার সামাজিকতা রক্ষা করে সেখানে শরিক হওয়ার মতো সচ্ছলতা নেই। এ এক উভয়সংকট। আর বিয়ের দাওয়াতের অর্থই হলো- আপনাকে উপস্থিত হতে হবে এবং মানসম্মত উপহার নিয়ে যেতে হবে। এ উপহার গ্রহণ করার জন্য করা হয় নজরকাড়া আয়োজন। তা আবার ‘দলিলস্বরূপ’ লিখেও রাখা হয়। এরপর চলে হিসাব কে কত দিল এবং কত খরচ হলো আর কত টাকা উঠে এলো। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক বাস্তবতা এমনই।

কারো বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় যেমন কখনো ফল নিয়ে কখনো মিষ্টি নিয়ে কিংবা অন্য আরও কিছু নিয়ে যাই আমরা, এসব অনুষ্ঠানে উপহারের বিষয়টিকেও যদি এরকম উন্মুক্ত রাখা হতো এবং সামাজিক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রাখা হতো, তাহলে এখনকার মতো সংকট সৃষ্টি হতো না। কেউ যদি সামাজিক কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে কাউকে হাদিয়া দেয় আর তা আন্দাজ করা যায়, তবে তা গ্রহণ করা কতটুকু বৈধ হবে এটা ভাবনার বিষয়। হ্যাঁ, কেউ যদি আন্তরিকভাবে কাউকে উপহার দিতে চায়, কারো আনন্দে সে একটু শরিক হতে চায়, তাহলে এ সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এজন্য আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতা কেন?

আমরা যদি এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে চাই, তাহলে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে আমন্ত্রকদের। তারা যদি অনুষ্ঠানে কেবল অতিথিকে বরণ করে আর উপহার গ্রহণের আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা না রাখে, তবে অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়বে এ অন্যায় সামাজিকতা। আর যারা অতিথি, তারাও যদি একটু হিম্মত করতে পারে, তাহলে তো দাফনই হয়ে যেতে পারে এ অন্যায়ের।

কিছু কিছু মানুষকে উদ্যোগী হতে দেখাও যায়। হয়তো এ উপলব্ধি থেকেই তারা ওলিমার দাওয়াতপত্রে লিখে দেন- ‘দয়া করে সঙ্গে কোনো গিফট আনবেন না।’ এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এর দ্বারা আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেরই হয়তো টনক নড়বে। আরও মানুষ উদ্যোগী হবে।

সামাজিক চাপ নয়, হাদিয়া আদান-প্রদান হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ইসলামের হাদিয়ার যে ধারণা ও শিক্ষা সে অনুসারে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (কাউকে কিছু) দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকে; আল্লাহর জন্যই যে ভালোবাসে আর আল্লাহর জন্যই যে ঘৃণা করে, … সে তার ইমান পূর্ণ করল।’ -জামে তিরমিজি : ২৫২১

তাই প্রচলিত সামাজিক রীতি-রেওয়াজের অন্ধ অনুসরণ নয়, পূর্ণ ইমানের অধিকারী হতে চাইলে প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে। সমাজ কী বলল- সেটা দেখার বিষয় নয়। এটাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের পরিচয়। সামাজিকতার চাপে নয়, কাউকে যদি কিছু সে উপহার দেয়, তাহলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে, যদি কাউকে না দেয়, তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ইমানের পূর্ণতার জন্য আমাদের এখানে উঠে আসতেই হবে।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION