রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাংলাদেশি কারিদের তেলাওয়াত এখন অনেক উন্নত

ইসলাম। ফাইল ছবি।

আন্তর্জাতিক কোরআন তেলাওয়াত সংস্থা ইক্বরার সভাপতি ও বাংলাদেশ কিরাত ইনস্টিটিউটের পরিচালক কারি আহমাদ বিন ইউসুফ আল আজহারী। বিভিন্ন দেশে কেরাত প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াতের জন্য ভ্রমণ করছেন প্রায় ৩০টি দেশ। সম্প্রতি মুখোমুখি হয়ে কথা বলেন কোরআন তেলাওয়াত ও শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ে।

প্রশ্ন : পবিত্র কোরআনের নানাদিক রেখে শুধু কেরাত চর্চার দিকটি কেন বেছে নিলেন?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : কোরআনে কারিম এমন একটি কিতাব, যার নানাদিকের মধ্যে সরাসরি আলফাজে কোরআন তথা কোরআনের শব্দের তেলাওয়াতের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি। হাদিসে সুস্পষ্টভাবে আলফাজে কোরআনের খাদেমদের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার লাভ বিভিন্ন মর্যাদার কথা বলা হয়েছে।

এ ছাড়া আপনারা জানেন, আমার আব্বা কারি মো. ইউসুফ (রহ.)- এর হাত ধরে ভারত-পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশে কেরাতের এই ময়দানের জন্ম। তিনি সব সময় আল্লাহর কাছে চাইতেন, এমনকি ১৯৭৯ সালে পবিত্র কাবায় প্রবেশের পর সেখানেও আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে তার হাতে-গড়া এই ময়দানের একজন ভবিষ্যৎ কান্ডারি যেন আল্লাহ তার বংশে দান করেন। আব্বাজান (রহ.) ছোট থেকেই আমাকে এ বিষয়ে কিছু করার জন্য সব সময় উৎসাহ দিতেন এবং নিজে আমাকে শিখিয়ে উত্তরসূরি হিসেবে তৈরি করেছেন- আলহামদুলিল্লাহ।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে তো শাস্ত্রীয়ভাবে কেরাত শেখার সুযোগ তেমন ছিল না, আপনি কীভাবে শিখলেন?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : এর উত্তর দিতে হলে আমাকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। আসলেই আমাদের এই অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে শাস্ত্রীয়ভাবে কেরাত শেখার কোনো ব্যবস্থা একেবারেই ছিল না। আঠারো শো শতকের শুরুতে উজানির পীর কারি ইবরাহিম (রহ.) তার সাধ্য অনুযায়ী চাঁদপুর অঞ্চলে ইলমে তাজবিদের খেদমত শুরু করেন, যা ছিল তৎকালীন সময়ে অনেক বড় কিছু। তারপরও শাস্ত্রীয় কেরাতের তালিম এবং উচ্চতর গবেষণা অধরাই রয়ে যায়।

পরবর্তীকালে ১৯৫৭ সালে আব্বাজান (রহ.) পাকিস্তানে গিয়ে বিভিন্ন দেশের উস্তাদদের কাছ থেকে শাস্ত্রীয় কেরাতের ওপর শিক্ষা অর্জন করে সেখানেই শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। আব্বাসহ কারি শাকের কাসেমি (রহ.) ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তান বেতার এবং পিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক কেরাত সম্মেলনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এই শাস্ত্রকে পরিচিত করে তোলেন। যে কারণে অনেকের মধ্যে কেরাত শেখার আগ্রহ জাগে এবং শেখার ব্যবস্থা হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শাস্ত্রীয়ভাবে কেরাত শেখার স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান মাহাদুল কেরাত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশের কারিগণ হজরত ইউসুফ (রহ.)-এর হাতে-গড়া শিষ্য। আমিও আব্বাজান (রহ.)-এর কাছেই কেরাত শিখেছি। পরবর্তীকালে আজহারের মাহাদুল কেরাতে পড়াশোনা করার সৌভাগ্য হয়।

প্রশ্ন : আপনার বাবা অনেক বড় কারি ছিলেন, কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তার সম্পর্কে খুব একটা জানেন না এর কারণ কী?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : আসলে বিষয়টি এমন নয়, তিনি তার যুগে সোশ্যাল মিডিয়া না থাকা সত্ত্বেও সবার মধ্যে বেশ পরিচিত ছিলেন। বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতারে সব সময় তার কোরআন তেলাওয়াত সম্প্রচার করা হতো। বিশেষ করে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ে তার বিচরণ ছিল। এটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের আপামর জনতার কাছে পবিত্র কোরআনকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিরাম কাজ করে গেছেন। যেমন বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করানো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রস্তাব দিয়ে সরকারিভাবে দেশব্যাপী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আজান-কেরাত, হামদ-নাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করানো। জেনারেল এরশাদকে প্রস্তাব দিয়ে সামরিক বাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আজান-কেরাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করানো। তিন বাহিনীতে এই প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার হিসেবে হজে পাঠানো হয় যা এখনো চলমান।

এ ছাড়া তিনি জাতীয় মসজিদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইমাম-খতিব নিয়োগ বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, আন্তর্জাতিক হেফজ-কেরাত প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ বাছাইপর্বে প্রধান বিচারক থাকতেন। রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠান তার কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হতো, কারণ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যাকে বাংলাদেশের প্রধান কারি হিসেবে সরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি ঢাকার বাইরে মাহফিলে যাওয়া পছন্দ করতেন না, বলতেন মাহফিলে আসা-যাওয়ায় যে সময় নষ্ট হবে, তার চাইতে আমি কিছু ছাত্র তৈরি করি। যারা ভবিষ্যতে এই দেশে মানুষকে কোরআন শেখাবে।

দেশ রূপান্তর : তেলাওয়াতের সূত্রে বিশ্বের অনেক দেশ সফর করছেন, সংখ্যাটা কী মনে আছে?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের সূত্রে বিভিন্ন দেশে সফর, মানুষের ভালোবাসা ও সম্মানপ্রাপ্তির জন্য প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করি। বর্তমান বিশ্বে এত এত কারি বিশেষ করে আরবে অনেক অভিজ্ঞ কারি থাকা সত্ত্বেও আমাকে তেলাওয়াতের জন্য কিংবা প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে দাওয়াত করে। এটা আমার ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পর্যন্ত ২৯টি দেশে অসংখ্যবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।

দেশ রূপান্তর : দেশের যেসব শিক্ষার্থী কারি আবদুল বাসেতের মতো কারি হতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন? তাদের নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে কি?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : কারি আবদুল বাসেত (রহ.) নিঃসন্দেহে অনেক বড় ব্যক্তিত্ব। তার মতো হতে হলে অবশ্যই শিক্ষার্থীকে মোত্তাকি (যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করেন) ও মুখলিস (একনিষ্ঠ) হতে হবে। উস্তাদদের দোয়া নিতে হবে, তাদের সঙ্গে কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করা যাবে না। আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুখলিস ও মোত্তাকির সংখ্যা একেবারেই কম। তারপরও আমি আশাবাদী। আমি চাই, আমাদের ছেলেরা আরবদের মতো কোরআন তেলাওয়াত করুক।

২০০৯ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার উস্তাদদের তেলাওয়াত সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছি এবং দিচ্ছি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের হাফেজ এবং কারিদের তেলাওয়াতের মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন সুরে তেলাওয়াত করছে, যা ১২ বছর আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। আমি নীরবে হাজার হাজার যোগ্য উস্তাদ তৈরি করছি, তারাই লাখো লাখো ছাত্র তৈরি করছে এবং করবে ইনশাআল্লাহ।

দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশে আপনার বাবার হাত ধরে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক কেরাত সম্মেলন শুরু হয়, যা বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সম্মেলনে রূপ নিয়েছে। এত সম্পদশালী মুসলিম দেশ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কীভাবে তিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন?

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : আসলে যে কাজে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) থাকে আল্লাহতায়ালা ওই কাজে বরকত দান করেন। যে কাজ হিংসা-বিদ্বেষ দিয়ে শুরু হয়, সেই কাজে আল্লাহ সফলতা দেন না, আব্বাজান (রহ.)-এর বাস্তব প্রমাণ। তিনি এই সম্মেলন বাস্তবায়নের জন্য বছরের ৬ মাস একেবারে বিশ্রামহীন কাটাতেন। সারা দিন পায়ে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন কাজে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতেন এবং রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে আল্লাহর কাছে সম্মেলনের কামিয়াবির জন্য অঝোরে চোখের পানি ফেলতেন। মূলত তার এই চোখের পানির ফসল আজকের এই বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘ইক্বরা আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন বাংলাদেশ।’

দেশ রূপান্তর : গণমাধ্যমগুলো কীভাবে পবিত্র কোরআনের প্রচারে আরও বেশি উদ্যোগী হতে পারে বলে মনে করেন।

কারি আহমাদ বিন ইউসুফ : একজন মুসলিম হিসেবে প্রতিটি মানুষের ওপর কিছু দায়িত্ব বর্তায়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশের গণমাধ্যমে যেভাবে কোরআনের কার্যক্রম প্রচার হওয়ার দরকার ছিল, তা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। কোরআনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান উঁচুতে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে মিডিয়াগুলো সেভাবে কাজ করে না। বরং বলা যায়- এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে। এভাবে চলতে থাকলে এ সম্পদগুলোকে এ দেশ এক সময় হারিয়ে ফেলবে। দায়িত্ব হিসেবে গণমাধ্যমগুলোর উচিত, পবিত্র কোরআনের কাজ এবং কোরআনওয়ালাদের বেশি বেশি প্রচার করা।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION