রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩ অপরাহ্ন
শায়খ ড. আলী আল হুযাইফি:
আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের ইমানদার বলে সম্বোধন করে তার কাছে সৎকর্মের মাধ্যমে অসিলা গ্রহণ করতে ও তা (সৎকর্মসমূহ) ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে হেফাজত করতে বলেছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ও তার কাছে অসিলা তালাশ করো এবং তার পথে জিহাদ করো; যেন তোমরা সফল হতে পারো।’ সুরা আল মায়েদা : ৩৫
অসিলা হচ্ছে, যাবতীয় আনুগত্যমূলক আদেশ পালন ও নিষিদ্ধ কাজ পরিহার। ফলে অসিলা বলতে ভালো কাজের সব মাধ্যমই এর অন্তর্ভুক্ত।
যাবতীয় কল্যাণের দ্বার, শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দাতা, সৎকর্মের পথসমূহকে যুক্তকারী ও আমল বিধ্বংসী থেকে হেফাজতকারী বস্তু হচ্ছে আল্লাহর জিকির, যা ফরজ ও ওয়াজিবসমূহকে পূর্ণতা দেয় এবং ইবাদতের ঘাটতিগুলো পূরণ করে। পাশাপাশি ভালো কাজের সওয়াব বাড়িয়ে দেয় ও পাপ মোচন করে। সম্মান, আলো ও কল্যাণের সোপান হিসেবে এর সওয়াব, ফজিলত ও গুরুত্বের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আল্লাহতায়ালা তার জিকিরকে নামাজ, হজসহ অধিকাংশ ইবাদতে আবশ্যক করে দিয়েছেন। শরিয়ত সর্বাবস্থায় এর প্রতি উৎসাহিত করে। তা ছাড়া দ্বীনের প্রথম ভিত্তি হচ্ছে ‘আশহাদুআল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ’ বলে আল্লাহর জিকির করা। ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান মূলত এই জিকিরের ব্যাখ্যা এবং এই শাহাদাতের (কালেমা) শাখা-প্রশাখা হিসেবে এসেছে। ‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ (উপাস্য) নেই’ এই সাক্ষ্যতে রয়েছে আল্লাহর একাত্ববাদের ঘোষণা এবং ‘মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’ এই সাক্ষ্যতে আছে এককভাবে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ ও তার স্বীকৃতি।
আল্লাহর জিকির অধিকহারে করতে যেভাবে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে অন্য কোনো ইবাদতের ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দেননি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল ও সন্ধ্যা তার গুণকীর্তন করো।’ সুরা আল আহজাব : ৪১-৪২
জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো, যেন তোমরা সফল হতে পারো।’ সুরা আল জুমুআ : ১০
হাদিসে এসেছে, হজরত আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে তার রবের জিকির করে আর যে জিকির করে না, তাদের উপমা হচ্ছে জীবিত ও মৃত ব্যক্তি।’ সহিহ বোখারি
জিকির আমলকে পবিত্র করে, আমলের ঘাটতি পূরণ করে, জিকিরকারী তা দ্বারা প্রয়োজন মেটাতে পারে, তার গোনাহও মোচন করে। আল্লাহর জিকিরের তিনটি স্তর রয়েছে
প্রথম : অন্তরে আল্লাহর জিকির করা। আল্লাহ স্বীয় বদান্যতায় এ জন্য প্রতিদান দেবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ বলেন, আমি সে রকমই যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি।’ সহিহ বোখারি
দ্বিতীয় : এটা মধ্যম অবস্থা, তা হচ্ছে- মুসলিম তার রবকে মুখে স্মরণ করবে, কখনো বা সে জিকিরের মর্ম অনুধাবনে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সেও এক্ষেত্রে বিশাল কল্যাণের ওপরে আছে। আর তার প্রতিদান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অতিরিক্ত মৌখিক উচ্চারণের কারণে এটা প্রথমটার চেয়ে উত্তম। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় বান্দা কখনো আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কথা বলে অথচ সে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। কিন্তু এ কথার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।’ সহিহ বোখারি
তৃতীয় : মুখে উচ্চারণ ও তার অর্থ অন্তরে অনুধাবন এবং জিকিরের সময় আল্লাহর মহত্ব স্মরণ করা। এটাই জিকিরের সর্বোচ্চ স্তর। এরূপ জিকিরকারীরা কল্যাণের দিকে অগ্রগামী ও সর্বোচ্চ সম্মানিত। রিফায়া জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো বান্দা আন্তরিকভাবে এই সাক্ষ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল, অতঃপর তা বাস্তবায়ন করবে; তবে সে জান্নাতে চলতে থাকবে।’ মুসনাদে আহমাদ
জিকিরের অর্থ হচ্ছে- ‘তাহলিল, তাকবির, তাহমিদ, তাসবিহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম’ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর গুণকীর্তন এবং বেশি বেশি ইস্তেগফার ও দোয়া করা। এমনকি নবীর ওপর দরুদ ও সালাম পড়াও জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে আমাদের রবকে যাবতীয় অপূর্ণতার ঊর্ধ্বে রাখা এবং তার শানে, মর্যাদায়, বড়ত্বে, পূর্ণতায় ও সৌন্দর্যে যা সমীচীন নয় তা থেকে পবিত্র ঘোষণা করা। সৃষ্টির কারও সঙ্গে তার সাদৃশ্য সাব্যস্ত না করা।
বিশে^র প্রতিপালকের প্রশংসার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে তার সুন্দর নাম, মহান গুণাবলি ও হেকমতপূর্ণ কাজের মাধ্যমে প্রশংসা করা। যেমনটি আয়াতুল কুরসি ও সুরা হাশরের শেষাংশে এসেছে। অনুরূপভাবে সৃষ্টিজীবের প্রতি আমাদের রবের নেয়ামতসমূহ উল্লেখ করার মাধ্যমেও তার মহত্ব বর্ণনা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। আল্লাহ ছাড়া কি কোনো স্রষ্টা আছে যে, তোমাদের আসমানসমূহ ও জমিন থেকে রিজিক দান করে?’ সুরা ফাতির : ৩
এ রকম আরও অনেক আয়াত এসেছে। জিকির হচ্ছে এমন যা উচ্চারণে হালকা, তবে ওজনে ভারী। আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি মহব্বত ব্যতীত এর প্রতিদান দেওয়া হয় না, অন্তর পবিত্র হয় না, আমল ও জীবন ত্রুটিমুক্ত হয় না। সর্বোত্তম জিকির হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত করা। এতেই বিশ^ প্রতিপালকের যাবতীয় প্রশংসা, নেয়ামতের উল্লেখ, বিধিবিধানের তফসিল, ভালো কাজে উৎসাহ ও অন্যায় থেকে সতর্কবাণী ইত্যাদি রয়েছে।
জিকিরের কল্যাণ, বরকত ও উপকার এমনই। আর সওয়াবের ক্ষেত্রে এর প্রতিদান এমন, যা কোনো চক্ষু দেখেনি, যা সম্পর্কে কোনো মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। এর সওয়াব সম্পর্কে যা এসেছে তন্মধ্যে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনে একশবার এ দোয়াটি পড়বে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আল্লা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ তাহলে দশটি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব হবে। তার জন্য একশটি সওয়াব লেখা হবে এবং আরও একশটি গোনাহ মিটিয়ে ফেলা হবে। ওইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সে শয়তান হতে সুরক্ষিত থাকবে। কোনো লোক তার চেয়ে উত্তম সওয়াবের কাজ করতে পারবে না, তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া যে এর চেয়েও ওই দোয়াটির আমল বেশি পরিমাণ করবে।’ সহিহ বোখারি
জিকিরের আরেকটি ফজিলত হচ্ছে, জিকির ব্যক্তিকে শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে রক্ষা করে। জিকিরের সবচেয়ে বড় প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। তা ছাড়া আল্লাহতায়ালা জিকিরকারীকে যাবতীয় বিপদাপদ ও ক্ষতিকারক বস্তু হতে রক্ষা করেন। আল্লাহ জিকিরকারীকে উভয় জগতে সম্মান বৃদ্ধি করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব এবং তোমরা আমার শোকরিয়া আদায় করো, আর অবিশ্বাসী হয়ো না।’ সুরা আল বাকারা : ১৫২
জিকির দেহমনকে শক্তিশালী করে, ইবাদতে সহযোগী হয়, হারাম থেকে বাধা দেয় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ রিজিক সহজলভ্য করেন। জিকিরের মাধ্যমে নেফাকি থেকে মুক্ত হওয়া যায়, যা একটি বড় পাপ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া ও জিকিরের সময় ব্যাপক অর্থবহ শব্দ চয়ন করতেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যা তিনি জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা.)-কে শিখিয়েছেন, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি আদাদা খালকিহি ওয়ারিজা নাফসিহি ওয়াজিনাতা আরশিহি ওয়ামিদাদা কালিমাতিহি।’ সহিহ মুসলিম
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহকে সর্বদাই স্মরণ করতেন। সহিহ মুসলিম
বর্তমান যুগে মুসলমানদের বেশি বেশি জিকির করা প্রয়োজন। যেহেতু ফেতনার আধিক্যতা, অন্তরের উদাসীনতা এবং চক্ষুসমূহ বিভিন্ন প্রবৃত্তির দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্যের ধোঁকা প্রাধান্য বিস্তার লাভ করেছে। তাই মুসলিমের উচিত জিকির আজকারের কিতার সংগ্রহ করা, যেন তা দ্বারা সে উপকার লাভ করে ও আমল করতে পারে।
৬ অক্টোবর শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ