রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৯ পূর্বাহ্ন
শায়খ হুসাইন বিন আবদুর আজীজ আলে শায়খ:
ব্যক্তি ও সমাজের ওপর ভয়াবহ বিপদের অন্যতম হলো, প্রমাণ ছাড়া বিভিন্ন গুজব ও ভুয়া সংবাদ প্রচার; যার সত্যতার কোনো ভিত্তি নেই। সেগুলো এমন গুজব যা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে অজ্ঞাতনামা উৎস থেকে ছড়ানো হয়। যে অজ্ঞাতনামা উৎস গুজব প্রচার করে এবং ব্যাপক পরিসরে ফেতনা ও কলহ উসকে দেয়। বিচিত্র ধরনের গুজব, যা আতঙ্ক তৈরি করে; উত্তেজনার প্রসার ঘটায় এবং মুসলিম শাসক ও আলেম-উলামাদের ব্যাপারে অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্দ ও অশ্লীলতা প্রচার করে। নিঃসন্দেহে এসব গুজব ধ্বংসাত্মক অস্ত্রস্বরূপ, যা জাতিকে ধ্বংস করতে এবং তাদের ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরাতে শত্রুরা ব্যবহার করে থাকে। ধ্বংসাত্মক গুজব হলো ইসলামের শত্রুদের তৈরিকৃত অস্ত্র, যা আল্লাহ প্রদত্ত পথ ও ঐশ্বরিক বিধান থেকে মানুষদের বাধা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গুজব একটি সুনিপুণ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, যা পরিকল্পিত নীতিমালার আলোকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও চারিত্রিকভাবে এবং শান্তি ও যুদ্ধ বিষয়ে দেশসমূহকে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়।
গুজবের ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের অবস্থান হলো, ইসলামি নীতির অনুসরণ করা। যা সজাগ ও সতর্কতা অবলম্বন এবং এর ক্ষতির অনুধাবন করতে আহ্বান করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের কাছে পৌঁছে কোনো সংবাদ শান্তি-সংক্রান্ত কিংবা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। আর যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রাসুল পর্যন্ত কিংবা তাদের শাসকদের পর্যন্ত, তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেত সেসব বিষয়, যা তাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মতো। বস্তুত আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা যদি তোমাদের ওপর বিদ্যমান না থাকত তবে তোমাদের কতিপয় লোক ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে শুরু করত!’ -সুরা আন নিসা : ৮৩
বর্ণিত আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের কাছে যখন জনসাধারণ বিষয়ক কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আসে যা নিরাপত্তা ও মুমিনদের আনন্দের সঙ্গে কিংবা বিপদ সংবলিত কোনো আতঙ্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন তাদের কর্তব্য হলো তা যাচাই-বাছাই করা ও তৎক্ষণাৎ তা প্রচার না করা। বরং নবী কারিম (সা.)-এর মৃত্যুর পর দায়িত্বশীলদের তা জানানো, যারা প্রকৃত বিষয় জানে এবং এই সংবাদ প্রচারের অন্তরালের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে অবগত। এই কৌশলের আলোকে কোনো সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রচার করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বরং অবশ্যই সূক্ষ্ম চিন্তা ও গভীর দৃষ্টির সঙ্গে তার বাস্তবতা ও পরিণতি সম্পর্কে জানতে হবে। বিদ্বানরা বলেছেন, সত্যতা যাচাই ও তা প্রচারে ক্ষতি না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া ছাড়া সংবাদ প্রচারকে হারাম করা হয়েছে, বিশেষত ফেতনার সময়ে। আল্লাহতায়ালা আমাদের যাচাই-বাছাই ও নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে আদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে ইমানদাররা! যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ, এ আশঙ্কায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে হবে।’ -সুরা আল হুজুরাত : ০৬
নবী কারিম (সা.) তার উম্মতকে যাচাই করা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রচার করার পদস্খলন থেকে সতর্ক করেছেন। সহিহ বোখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় বান্দা এমন কথা বলে যার পরিণাম সে চিন্তা করে না, অথচ এ কথার কারণে সে নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামের এমন গভীরে যার দূরত্ব পূর্ব-প্রাচ্যের দূরত্বের চেয়ে অধিক।’ অর্থ হলো, সে এমন বিষয়ে কথা বলে যে বিষয়ে সে খেয়াল করে না, তার ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তা করে না এবং এর মধ্যে নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে অনুমান করে না। বস্তুত নবী কারিম (সা.)-এর নীতির মধ্যেই ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তা নিহিত। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরব থাকে।’ -সহিহ বোখারি
নবী কারিম (সা.) আমাদের সংবাদের সত্যতা সম্পর্কে অবগত না হয়ে তা প্রচার করার ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, ‘‘লোকদের ধারণা এরূপ’ এটি মানুষের কতই-না মন্দ বাহন!’’ -সুনানে আবু দাউদ
ধারণা শব্দটি ব্যবহার করা হয় এমনক্ষেত্রে যে বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা জানা যায় না, যেমনটি আলেমরা উল্লেখ করেছেন। বরং তা সন্দেহপূর্ণ ও অনুমান নির্ভর বিষয়ে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং মুসলমানদের কর্তব্য হলো, শরিয়তের নীতিমালা মেনে চলা; বিশৃঙ্খলা ও ক্ষতি নিরোধে সংবাদ যাচাই-বাছাই করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার কাছেই রয়েছে।’ -সুরা কাফ : ১৮
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের গোনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা-ই অন্যের কাছে বলে বেড়ায়।’ -সহিহ মুসলিম
সুতরাং যে ব্যক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া যা শোনে তাই বলে বেড়ায় সে মিথ্যায় পতিত হয়। তাই আপনারা গুজব ও মিথ্যা প্রচারণার পরিণাম থেকে সাবধান থাকুন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন, অনর্থক কথাবার্তা, সম্পদ নষ্ট করা এবং অত্যধিক প্রশ্ন করা।’ -সহিহ বোখারি
মুসলিম উম্মতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সচেতন জাতি। প্রচারিত সব বিষয় যাচাই-বাছাই ছাড়া তারা সত্য বলে গ্রহণ করে না। সুতরাং শত্রুর ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা সম্পর্কে প্রতিটি মুসলিমের বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা এবং পূর্ণ সচেতনতার পরিচয় দেওয়া অপরিহার্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারাই শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হন।’ -সুরা আল মুনাফিকুন : ০৪
নিঃসন্দেহে দীনি মূলনীতি অনুযায়ী আমল, প্রজ্ঞানুসারে কর্মসম্পাদন, পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার দক্ষতা, দায়িত্বশীলদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দীন ও দুনিয়ার কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজবের অনিষ্টতা প্রতিহত করে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনর্থক ও নিষ্ফল তর্কযুদ্ধ করা থেকে সবার সতর্ক থাকা আবশ্যক। যেকোনো ইস্যুর পেছনে দৌঁড়ানোর ব্যাপারে সবার সাবধান হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে তাদের জন্য কথা শুনার লোক রয়েছে।’ -সুরা আত তাওবা : ৪৭
আপনারা সতর্ক থাকুন, বিশেষত বর্তমান সময়ের মতো বিপদ-আপদের দিনগুলোতে সে সমস্ত ইস্যু থেকে যেগুলোকে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লুফে নেয়; যেমন সেসব মিথ্যা দাবি-দাওয়া যার বাহ্যিকরূপ হলো জাতির প্রতি একনিষ্ঠতা ও তার সমস্যাগুলোর প্রতি আন্তরিকতা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা জাতির জন্য বিরাট ফেতনা, ভয়াবহ বিপদ ও ভয়ানক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে।
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছড়ানো ফেতনার বিষয়ে এখন সময় এসেছে মনস্তাত্ত্বিক আবেগ ও অনুভূতিমুক্ত হয়ে প্রজ্ঞাপূর্ণ সঠিক কাজ করার। সময় এসেছে হেকমতপূর্ণ সঠিক পথ অবলম্বনের, যা শরিয়তের অন্যতম লক্ষ্য; ঐক্য বজায় রেখে জীবনকে সুশৃঙ্খল করা এবং দ্বীন ও অন্য বিষয়গুলোকে বিজয়ী করার নিমিত্তে। মুসলিম জাতির জন্য আবশ্যক হলো, শরিয়তের মূলনীতি ও হেকমতপূর্ণ নীতিমালা অনুসারে ফলপ্রসূ সহযোগিতা, ইমানি ভ্রাতৃত্ব এবং সহায়তার মাধ্যমে ফেতনার মোকাবিলা করা। মুসলিমদের সাহায্যের লক্ষ্য যখন খাঁটি নিয়তে হবে, নবী কারিম (সা.)-এর সুন্নাহর আলোকে সঠিকভাবে হবে এবং ইসলামি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সুস্পষ্ট, গভীর ও পরিকল্পিত ভাবনার আলোকে তা প্রণীত হবে, শুধুমাত্র প্রশংসনীয় আবেগের ওপর নির্ভর করে নয়; তখন পরিণতি প্রশংসনীয়, ফলাফল উপকারী এবং কর্ম সফল হবে।
পক্ষান্তরে যারা অপবাদ ও ফেতনা সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করে, মূলত তারাই সুযোগসন্ধানী শত্রুদের পথ অনুসরণ করে। বস্তুত মুসলিম জাতি পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, অংশীদারত্ব, কল্যাণ কামনা, নিষ্ঠা ও সততার জাতি; তারা পারস্পরিক লাঞ্ছনা, বিরোধ, ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার জাতি নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সৎকাজ ও তাকওয়ায় পরস্পরে সহযোগিতা করো।’ -সুরা আল মায়েদা : ২
১০ নভেম্বর শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ