শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন
মাওলানা আবদুল জাব্বার:
রবিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের ১১ কোটি ৯৬ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়। রাষ্ট্রের নাগরিকরা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বাছাইয়ের সুযোগ পায়।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল ও প্রার্থীদের জন্য ভোট হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার মোক্ষম হাতিয়ার। আবার অনেক ভোটারের কাছে ভোটের গুরুত্ব খুবই সামান্য। তবে সাধারণ হিসাব অনুযায়ী অধিকাংশ ভোটার দলভিত্তিক ভোট দিয়ে থাকেন, অনেকেই আবার এলাকার উন্নয়নমূলক কাজকর্ম যার দ্বারা বেশি হবে বলে মনে করেন, তাকে মানুষ ভোট দিয়ে থাকেন। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ খুবই ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। তাই ভোট দেওয়ার আগে ইসলামের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব ও হাকিকত জেনে নেওয়া দরকার।
ভোট কী : হজরত মুফতি মুহাম্মাদ শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ সংক্রান্ত এক পুস্তিকায় লিখেছেন যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। ১. সাক্ষ্য প্রদান ২. সুপারিশ ও ৩. প্রতিনিধিত্বের অথরিটি প্রদান।
কোরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সবারই জানা রয়েছে যে, শরিয়তে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তৈরির এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বের সনদ দেওয়ার মানে হচ্ছে, প্রতিনিধিত্ব দানকারী (ভোটার) তার ভবিষ্যৎ সব কার্যকলাপের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিচ্ছে। এমনিভাবে সুপারিশের বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য। কোরআন মাজিদের ভাষায়, ‘যে ভালো সুপারিশ করবে সে তার নেকির ভাগী হবে। আর যে মন্দ সুপারিশ করবে সেও মন্দের হিস্যা পাবে। সুরা আন নিসা : ৮৫
ভোট ও সাক্ষ্য : ভোটের মধ্যে যে তিনটি (সাক্ষ্য প্রদান, সুপারিশ, প্রতিনিধিত্বের সনদপ্রদান) বিষয় রয়েছে এর মধ্যে সাক্ষ্যের বিষয়টি মৌলিক। অর্থাৎ কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হলো, তার ব্যাপারে এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ভালো এবং যোগ্য। এখন যদি যথাযথ জায়গায় সীল দিয়ে এ সাক্ষ্য প্রদান করা হয় তবে সে হবে সত্য সাক্ষী অন্যথায় হবে মিথ্যা সাক্ষী। আর মিথ্যা সাক্ষ্য যে কত বড় কবিরা গোনাহ ও হারাম কাজ তা কি কারও অজানা? অবশ্য বর্তমান যুগে অনেকের কাছে মিথ্যা কোনো বিষয়ই নয়। কথায়, লেখায়, ক্ষমতায়, আদালতে, বই-মিডিয়ায়, বক্তৃতা-ভাষণে সব জায়গায় মিথ্যার সয়লাব। অথচ মানবতার মুক্তির দূত রাসুলে কারিম (সা.) কঠিন ভাষায় মিথ্যা ও মিথ্যা সাক্ষ্যের নিন্দা করেছেন।
সুনানে তিরমিজির এক হাদিসে মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সমান অপরাধ বলা হয়েছে। বিখ্যাত হাদিস বিশারদ হজরত শামসুদ্দিন যাহাবি (রহ.) মিথ্যা সাক্ষ্যকে চারটি বড় গোনাহের সমষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে ১. নিজে মিথ্যা ও অপবাদ আরোপ করছে, ২. যার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছে তার ওপর জুলুম করছে, ৩. যার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে তার ওপরও প্রকৃতপক্ষে জুলুম করছে কারণ, সে যা কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিল না এ ব্যক্তি মিথ্যা সাক্ষ্যর মাধ্যমে তাকে এর অধিকারী করে তুলছে এবং এভাবে তাকে করছে জাহান্নামি ও ৪. মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার একটি হালাল কাজকে হারাম বানিয়ে নেওয়া।
মিথ্যা ও অবাস্তব সাক্ষ্যের ক্ষতি ও খেসারত বলে শেষ করার মতো নয়। হকদার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, অযোগ্য ও অপদার্থের উত্থান, দুর্নীতিবাজ ও শোষকশ্রেণির লোকদের ক্ষমতায়ন এসবই মিথ্যা সাক্ষ্যের ক্ষতি। এ কারণে ইনসাফ পছন্দ এবং যোগ্য ও সৎ-আমানতদার ব্যক্তিরা নীরবতা পালন করে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত থেকে নিজেদের দূরে রাখতে বাধ্য হন।
ভোট অবশ্যই দিতে হবে : উপরোক্ত আলোচনা পড়ে প্রশ্ন আসতে পারে যে, তা হলে তো বর্তমান সমাজে অধিকাংশ আসনের লোকদের ভোট দেওয়াই সম্ভব হবে না। কারণ, এমন লোক তো পাওয়া যাবে না, যার সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করা যায় এবং এ কারণে অনেকে ভোট দেওয়া থেকে বিরতও থাকেন, এমনকি বহু লোক ভোটার হতেও আগ্রহী হন না। সাধারণ বিবেচনায় এ চিন্তা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এক্ষেত্রে কিন্তু মুদ্রার ভিন্ন পিঠও রয়েছে। তা হচ্ছে, মন্দের ভালো বা তুলনামূলক কম ক্ষতিকে বেছে নেওয়া এবং অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করা। বর্তমানে ভোটকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনায় আনতে হবে এবং ভোটের মাধ্যমে অধিক ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। কোনো আসনে একজন লোককেও যদি সাক্ষ্য ও ভোট দেওয়ার উপযুক্ত মনে না হয় তবে তাদের মধ্যে যে জন নীতি-নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা ও কাজে-কর্মে অন্য প্রার্থীর তুলনায় কম খারাপ তাকেই ভোট দিতে হবে।
কারও ব্যাপারে যদি ইসলাম, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ-বিরোধী হওয়ার সুস্পষ্ট আলামত থাকে তবে ওই অসৎ ব্যক্তির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে ভোটারাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে।
মোটকথা, গণতন্ত্র ও বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির যতই ত্রুটি থাকুক এর কারণে ভোট দানে বিরত থাকা সমীচীন হবে না; বরং বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে, ভেবে-চিন্তে ভোটারাধিকার প্রয়োগ করতে হবে ভালো-মন্দের ভালো অথবা অন্তত কম মন্দের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টিতে কাউকে ভোটদানের অর্থ হবে, এ সাক্ষ্য দেওয়া যে, লোকটি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো।
ভয়েস/আআ