শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ইসলামি আইনশাস্ত্র প্রণয়নে ১৩ গবেষক

আসআদ শাহীন:

দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরু থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কাল হলো ইজতিহাদ (ধর্মীয় বিধান প্রণয়নে গবেষণামূলক প্রয়াস)-এর স্বর্ণযুগ। ইজতিহাদের ঊষালগ্নে ১৩ জন মুজতাহিদ ছিলেন। তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য উল্লেখ করা হলো

১. ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনা (রহ.), [জন্ম : ২৫ ডিসেম্বর, ৭২৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ]

তিনি একজন বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, হাফেজ এবং ফকিহ (ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ) এবং মুহাদ্দিসদের মধ্যে অগ্রগণ্য, যারা নবী কারিম (সা.)-এর হাদিস বিন্যস্ত ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তিনি সেই অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন, যাকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কুফায় হাদিস বর্ণনার সুযোগ দিয়েছিলেন এবং তার মুহাদ্দিস হওয়ার নেপথ্যে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর নিরলস প্রচেষ্টা ও প্রয়াস সর্বত্র স্বীকার্য। তার অন্যতম কৃতিত্ব হলো, তিনি কোরআন শরিফের আক্ষরিক এবং শব্দার্থিক চিহ্নগুলোকে কাগজের পাতায় নিয়ে এসেছেন। তার ইজতিহাদ ও ফিকাহ সংক্রান্ত তথ্য জানার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর শিক্ষক ছিলেন।

২. ইমাম মালেক বিন আনাস (রহ.), [জন্ম : ৭১১ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দ]

তিনি ‘ইমামু দারিল হিজরত’ উপাধিতে সমাদৃত এবং ইমামে মদিনা ও ইমামে আহলে হেজাজ উপাধিতে সুপরিচিত। এই মুজতাহিদ (গবেষক, প্রণেতা) ও ফকিহ প্রথমে হাদিস ও আইনশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন প্রথমে রাবিয়া রায়ি (রহ.)-এর থেকে, তারপর ইবনে হরমুজ (রহ.)-এর কাছ থেকে। তার শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম ইবনে শিহাব যুহরি (রহ.)। ‘আল মুদাওওয়ানাতুল কুবরা’ ও ‘মুয়াত্তা মালেক’ নামের দুই বিখ্যাত কিতাবের রচয়িতা এই ফকিহ মাজহাবে মালেকির প্রবর্তক।

৩. ইমাম হাসান বসরি (রহ.), [জন্ম : ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭২৮ খ্রিস্টাব্দ]

নবী কারিম (সা.)-এর ঘরে উম্মাহাতুল মুমিনিন উম্মে সালমা (রা.)-এর কোলে বড় হওয়া এই ফকিহের আসল নাম হাসান বিন ইয়াসার। তার মা ছিলেন হজরত উম্মে সালমা (রা.)-এর ক্রীতদাসী। তিনিই নাম রাখেন ‘হাসান’ এবং কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, হজরত উমর ফারুক (রা.) তার নামকরণ করেছেন। তার পিতা ইয়াসার ছিলেন হজরত যায়েদ বিন হারেস (রা.)-এর ক্রীতদাস। তিনি ‘ইমামুল আউলিয়া’ ও ‘ইমামুল মুহাদ্দিসিন’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। প্রত্যেক যুগের আলেমরা ইমাম হাসান বসরি (রহ.)-কে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও তরিকতের ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হজরত বিলাল ইবনে আবি বুরদা (রহ.) বলেন, ‘আমি হাসান বসরির চেয়ে সাহাবায়ে কেরামের মতো সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকে পাইনি।’

৪. ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.), [জন্ম : ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ]

হজরত ইমাম আজম (রহ.)-এর নাম নোমান এবং উপাধি আবু হানিফা। তিনি ৮০ হিজরিতে ইরাকের কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সাবিত, পিতামহ নোমান বিন মারযুবান ছিলেন কাবুলের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অন্যতম। তার প্রপিতামহ মারযুবান পারস্যের একটি অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তার পিতামহ পিতা সাবিতকে শৈশবে হজরত আলি (রা.)-এর খেদমতে নিয়ে আসেন। হজরত আলি (রা.) তার জন্য বরকতের দোয়া করেন। সেই দোয়া এমনভাবে কবুল হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতো মহান মুহাদ্দিস, ফকিহ ও আবিদ ও জাহিদ ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সুসংহত পদ্ধতিতে আইনশাস্ত্রের (ফিকহ) ভিত্তি স্থাপন করেছেন।

তিনি মাজহাবে হানাফির প্রবর্তক। হজরত মালেক বিন আনাস (রা.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ৬০ হাজার মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন।’ হজরত আবু বকর বিন আকিক বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা ৫ লাখ মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন।’ খতিব খাওয়ারজিমি বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা ৩ লাখ মাসয়ালা প্রণয়ন করেছেন। তন্মধ্যে ৩৮ হাজার ইবাদত-বন্দেগি সংশ্লিষ্ট এবং অবশিষ্ট মাসয়ালা লেনদেন ও আচার-আচরণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট।’

৫. ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.), [জন্ম : ৭১৬ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ]

বিদগ্ধ ফকিহ ও মুহাদ্দিস ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.) হাদিস সংরক্ষণ, বিন্যস্ত এবং বর্ণনায় এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে, শোবাহ বিন হাজ্জাজ, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং ইয়াহিয়া বিন মঈন (রহ.)-এর মতো জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিসরা তাকে ‘আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। তিনি বলেন, সে যদি তাবেইনদের যুগে হতো তাহলে তারও একটি বিশেষ অবস্থান

থাকত। বলা হয়, সমসাময়িক আইনশাস্ত্রে তার চেয়ে বেশি হালাল-হারামের বিষয়ে জানতেন এমন কেউ ছিল না। তাবেইনদের মধ্যে যাদের ফিকাহ ও হাদিসের ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হতো, তাদের একজন হলেন ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহ.)।

৬. ইমাম আওযায়ি (রহ.), [জন্ম : ৭০৭ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ]

সিরিয়ার ইসলামি আইনশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ফকিহ হলেন হজরত ইমাম আওযায়ি (রহ.)। তার আসল নাম আবদুল আজিজ, যা তিনি পরিবর্তন করে আবদুর রহমান রাখেন। তিনি দামেস্কের শহরতলি আল-আওযার বাসিন্দা। ৮৮ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ইয়ামামায় শিক্ষাজীবন শেষে সেখানে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর তিনি বৈরুতে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাগ্মী ও সাহিত্যিক এবং সিরিয়ার জনগণের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। আল্লামা যাহাবি (রহ.) তাকে শাইখুল ইসলাম এবং হাফেজ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ইমাম আবু যুরআহ (রহ.) বলেন, ইমাম আওযায়ি (রহ.) ফিকাহ শাস্ত্রের অনেক কিতাব রচনা করেছেন যা ঈর্ষণীয় এবং তিনি ছিলেন সিরিয়ার জনগণের আস্থাভাজন ও গ্র্যান্ড মুফতি।

৭. ইমাম শাফেয়ি (রহ.), [জন্ম : ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮২০ খ্রিস্টাব্দ]

ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর পুরো নাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস বিন আল আব্বাস বিন উসমান বিন শাফি আল-কুরাইশি আল-হাশিমি আল-মুত্তালিবি। ১৫০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের গাজায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০৪ হিজরিতে মিসরে মৃত্যুবরণ করেন। গাজায় তার বাবার মৃত্যুর পর ২ বছর বয়সে তার নিজের জন্মভূমি মক্কায় নিয়ে আসেন। ফলে তিনি মক্কায় বেড়ে ওঠেন ও পড়াশোনা করেন। শৈশবে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করে মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর আরবের অন্যতম অভিজাত গোত্র হুজাইলে চলে যান। সেখানে আরবি কবিতা ও কাসিদা মুখস্থ করেন এবং আরবি সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। মক্কার বড় মুফতি মুসলিম বিন খালিদের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের কৃতিত্ব লাভ করেন। তিনি যখন ফতোয়া দেওয়ার অনুমতি দেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৫। এরপর তিনি মদিনায় এসে ইমাম মালেক (রহ.)-এর কাছ থেকে ফিকাহ অধ্যয়ন করেন এবং মুয়াত্তার দরস নেন। তিনি মাত্র ৯ দিনে ‘মুয়াত্তা’ মুখস্থ করেন। একইভাবে তিনি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, ফাজিল ইবনে আইয়াদ এবং স্বীয় চাচা মুহাম্মাদ ইবনে শাফি (রহ.)-এর থেকে হাদিস বর্ণনা করেন। ২০০ হিজরিতে তিনি মিসরে হিজরত করেন এবং সেখানে তিনি নতুন মাজহাব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০৪ হিজরিতে রজবের শেষ শুক্রবার মিসরে ইন্তেকাল করেন। তার রচিত সংকলনের মধ্যে রয়েছে, ‘আল রিসালাহ’ যা উসুলে ফিকাহ বিষয়ে রচিত এবং ‘আল-উম’ তার বিখ্যাত কিতাব যাতে তার নতুন মাজহাব ‘মাজহাবে শাফেয়ি’-এর কথা উল্লেখ রয়েছে।

৮. ইমাম লাইছ বিন সাদ (রহ.), [জন্ম : ৭১৩ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৭৯১ খ্রিস্টাব্দ]

মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আলেম এবং ফকিহ ইমাম লাইছ বিন সাদ (রহ.) হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিসরসহ ইসলামি পণ্ডিতদের শিক্ষক হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে তিনি ছিলেন তার যুগের অগ্রগণ্য আলেমদের একজন। ওই সময়ে প্রায় সব হাদিস বিশারদ তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, তিনি হাদিস ও ফিকহের ইমাম ছিলেন। পরিতাপের বিষয় হলো, যদি তার ছাত্ররা তার ইজতিহাদ এবং ফিকাহ বিষয়ক মাসয়ালাসমূহ লিখে রাখতেন, তাহলে তিনিও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে পরিচিতি পেতেন। এ কারণেই ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন যে, তার ছাত্ররা তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে অর্থাৎ তারা তার ইলমসমূহ লিপিবদ্ধ করেননি।

৯. ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.), [জন্ম : ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ] তাবেইনদের সাহচর্যে যারা ধন্য হয়েছেন এবং দ্বীনি শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের অন্যতম হলেন ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.)। তৎকালীন আলেম এবং তার সম-সাময়িকরা তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি শুধু জ্ঞান ও হাদিসের ক্ষেত্রেই উচ্চ পদমর্যাদা অর্জন করেননি বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেমন তাফসির, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, সাহিত্য ও ভাষা, ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং নাহু-সরফেও পারদর্শী ছিলেন। ইমাম খতিবে বাগদাদি (রহ.) [মৃত্যু ৪৬৩ হি.] বলেন, ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.) হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি যখন কোরআনের তাফসির করতেন, তখন তিনি তাতেও সনদ উল্লেখ করতেন। ইমাম ইসহাক বিন রাহাবিয়া (রহ.) নিজেই একজন মাজহাব প্রণেতা এবং মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি হানাফি, মালেকি, হাম্বলি ও শাফেয়ি নামক কোনো মাজহাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ইবনে কাসির (রহ.) (৭৭৪ হি.) বলেন, ইসহাক বিন রাহাবিয়া ছিলেন সেই সময়ের একজন ইমাম। একটি দল তার মতানুসারে ইস্তিম্বাত (বাছাই) ও ইজতিহাদ করত। ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর তার লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাবুস সুনান ফিল ফিকহ’ অন্যতম।

১০. ইমাম আবু সাওর (রহ.), [জন্ম : ৭৬৪ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৬০ খ্রিস্টাব্দ]

তার পুরো নাম আবু সাওর ইবরাহিম বিন খালিদ বিন আবি আল-ইয়ামান আল-কালবি আল-বাগদাদি। ইবনে হিব্বান (রহ.) তার সম্পর্কে বলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ইমাম ছিলেন যে, সব ইমাম ফিকহ, ইলম, তাকওয়া ও সততার ক্ষেত্রে পুরোবিশ্বে রাজত্ব করেছেন। তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যারা এসব বিষয়ে কিতাব সংকলন করেছিলেন এবং সুন্নাহের উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন।

১১. ইমাম মুহাম্মদ (রহ.), [জন্ম : ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮০৫ খ্রিস্টাব্দ]

ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান আশ-শাইবানি ছিলেন তাবেঈ-তাবেইনদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর শিক্ষক এবং ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর শিষ্য ও বিশেষ উপদেষ্টা। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর পরে তিনি ছিলেন সেরা ছাত্র। শিক্ষকের চিন্তাধারা ও মতাদর্শ লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার কঠোর পরিশ্রম বর্ণনাতীত। ফিকহে হানাফির প্রথম সংকলক হিসেবে তিনি সুপ্রসিদ্ধির চূড়ায় আরোহণ করেন। এ ছাড়া তিনি বিদগ্ধ মুজতাহিদ ও মুয়াত্তার রাবি ছিলেন। একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আসল’ অধ্যয়ন করে (যা মাবসূত নামে পরিচিত) মন্তব্য করেন, এটি আপনার ছোট্ট মুহাম্মদের গ্রন্থের যদি এত মর্যাদা হয়! তাহলে আপনার বড় মুহাম্মদের কীর্তি কেমন হবে? পরে ওই পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আমি হালাল-হারাম ও নাসেখ-মানসুখ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর চেয়ে আর কোনো বড় আলেম দেখিনি। তার রচিত ৬টি কিতাবকে ফিকাহের পরিভাষায় ‘কুতুবে সিত্তাহ’ বলা হয়। ওই ৬ কিতাব হলো আসল বা মাবসুত, জামেউস সাগির, সিয়ারুস সাগির, জামিউল কাবির, সিয়ারুল কাবির ও যিয়াদাত।

১২. ইমাম দাউদ জাহরি (রহ.), [জন্ম : ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ]

তার পুরো নাম দাউদ বিন আলি বিন খালাফ জাহরি (রহ.)। ইসলামি ইতিহাসের স্বর্ণযুগের অন্যতম মুফাসসির, মুহাদ্দিস এবং ইতিহাসবেত্তা এই আলেম আহলে সুন্নাহর মুজতাহিদ আলেমদের একজন। তার খ্যাতির প্রধান কারণ হলো, ফিকহি মাজহাবে একটি নতুন মানহাজ বা মাসলাক অর্থাৎ ফিকহে জাহরি প্রতিষ্ঠা করা। ইবনে হাযম আল-আন্দুলুসি বলেন, তিনি ইসফাহানি উপাধিতে পরিচিত ছিলেন, কারণ তার মায়ের জন্মভূমি ছিল ইসফাহান এবং তার পিতা ছিলেন একজন হানাফি।

১৩. ইমাম ইবনে জারির তাবারি (রহ.), [জন্ম : ৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু : ৯২৩ খ্রিস্টাব্দ]

পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির বিন ইয়াজিদ আল-তাবারি (ইবনে জারির আল-তাবারি)। আব্বাসীয় যুগের একজন বিখ্যাত মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তা। তাবারিস্তানের বাসিন্দা হওয়ার কারণে তাবারি নামকরণ হয়। এলাকাটি যা মাজেন্দ্রান অঞ্চলের অন্তর্গত বর্তমান ইরান। ইমাম তাবারি (রহ.)-এর কিতাবসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় হলো তাফসিরগ্রন্থ ‘জামিউল বায়ান আন তাবিল’ (আল-কোরআন) এবং ‘তারিখুল রাসুল ওয়াল মুলুক।’ আগেরটি তাফসিরে তাবারি এবং পরেরটা তারিখে তাবারি নামে পরিচিত। তিনি ফিকহে শাফেয়ির অনুসারী ছিলেন, কিন্তু পরে তার মতামত ও ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে একটি মাসলাক প্রতিষ্ঠিত হয়- যা তারই নাম অনুকরণে জারিরি নামে পরিচিত।

তবে কালের আবর্তে তাদের অধিকাংশের মাজহাব হারিয়ে গেছে। সেগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্য শুধু বইয়ের পাতাতেই শোভা পায়। বর্তমান বিশ্বে প্রভাবশালী চারটি মাজহাবই (হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি) সর্বজনীনভাবে গৃহীত।

উল্লেখ্য, ফিকাহ হলো, আল্লাহপ্রদত্ত বিধানসমূহের সুবিন্যস্ত রূপ। এটি কোনো ফকিহের (ইমাম) নিজস্ব মনগড়া মতামত নয়। তাদের নিজেদের মনগড়া মতামত প্রদানের কোনো অনুমতি নেই; বরং তারা কেবল কোরআন-হাদিসে সুপ্ত আইনসমূহকে উম্মতের সামনে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেছেন। মাসয়ালা ও ফতোয়াগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ফকিহ ইমাম আবু হানিফা বা ইমাম মালেক বা ইমাম শাফেয়ি রাহিমাহুমুল্লাহুর দিকে সাধারণত এ জন্যই সম্বন্ধ করা হয় যে, তারা সেগুলো প্রকাশ ও উদঘাটন করেছেন, এ জন্য নয় যে এগুলো তাদের বানানো মতামত।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION