বুধবার, ০৯ Jul ২০২৫, ০৯:৩৫ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ:
উখিয়ার বালুখালী ১৮নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় ট্রেনিং সেন্টার করতে চেয়েছিল একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপ। একই সাথে উক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে দলে যোগ দেয়ার ছাপ দিয়ে আসছিল সন্ত্রাসীরা। এজন্য প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকিতে আতংকে ছিল মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এমনটি অভিযোগ করছেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহতের স্বজন ও সাধারণ রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সুত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর মুলত: ক্যাম্প জুড়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা। ক্যাম্পে কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রæপ রাত হলেই ক্যাম্প গুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এতে করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। রাতে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন না থাকায় রাত হলেই সন্ত্রাসীরা মাথাছাড়া দিয়ে উঠে। তবে সন্ত্রাসীদের ভয়ে কোন রোহিঙ্গা এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগ।
শুক্রবার দুপুরে ময়নাতদন্ত করতে আসা নিহত রোহিঙ্গাদের কয়েকজন স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। নাম প্রকাশে না করার শর্তে অনেকে জানিয়েছেন- কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ১৮নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসাটি ‘আরসা’র পরিচয়ে কিছু সন্ত্রাসী ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য ওই মাদ্রাসার সুপারকে ছাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এতে রাজি না হওয়ায় রাতে হামলা চালায়। এসময় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষক, ছাত্র ও ভলান্টিয়ার সহ ৬জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করে এবং আহত করে ১০/১২জন রোহিঙ্গাকে। নির্মম এই ঘটনার পরও হামলাকারি এসব সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পটি আশপাশে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু, সাধারণ রোহিঙ্গারা ভয়ে কোন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জানাতে পারছেন না। কারণ, দিনে আইনশৃংখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাত হলে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কথিত আরসা নামের সন্ত্রাসীদের হাতে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত রোহিঙ্গার আরেক স্বজন অভিযোগ করে জানান, ‘ক্যাম্পে রাতের অবস্থা খুব ভয়াবহ। দিন শেষে সন্ধ্যা হলেই নিয়ন্ত্রণে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপ। এই গ্রæপটি মিয়ানমারের রাখাইনে সাধারণ রোহিঙ্গাদের যে জুলুম-নির্যাতন করে আসছিল, ঠিক একই কায়দায় ক্যাম্প গুলোতে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্যাম্পগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। রাত হলেই এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রæপের বিচরণে ভয়ে রাত কাটে রোহিঙ্গাদের।’
রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, ‘আরসা’র নামধারী মৌলভী আবু বক্কর, মৌলভী নুর হোছন, খালেক, ফজলুল কবির, ইকবাল সহ অনেকেই উখিয়ার বালুখালী ২নং ক্যাম্পটি নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এ কারণে ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় ট্রেনিং সেন্টার করার পাশাপাশি মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসীদের দলে যোগ দেয়ার জন্য বলা হয়। দলে যোগ না দেয়ায় রাতে মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
জানতে চাইলে ক্যাম্পে নিয়োজিত ১৪নং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ‘এপিবিএন’র অধিনায় (পুলিশ সুপার) মো: নাঈমুল হক জানান- রাতে ক্যাম্প গুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এরপরও যদি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে আরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং নিহত ৬জনের হত্যাকারিদের ধরার জন্য পুলিশ অভিযান জোরদার করেছে।
শুক্রবার (২২ অক্টোবর) ভোর রাত ৪টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ১৮নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ নামের একটি মাদ্রাসায় হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এঘটনায় মাদ্রাসার ভেতরে রাতে হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১২, বøক-জে-৫ এর বাসিন্দা হাফেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষক মোঃ ইদ্রীস (৩২), ক্যাম্প-৯ বøক-১৯ এর মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর ছেলে ইব্রাহীম হোসেন (২৪), ক্যাম্প-১৮, বøক-এইচ -৫২ এর নুরুল ইসলামের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের ভলান্টিয়ার আবুল হোসেনের ছেলে মোঃ আমীন (৩২)। ‘এফডিএমএন’ ক্যাম্প-১৮, বøক-এফ-২২ এর মোহাম্মদ নবীর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), এফডিএমএন ক্যাম্প-২৪এর রহিম উল্লাহর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫) কে হত্যা করে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এসময় পুলিশ হামলাকারীদের সদস্য মুজিবুর নামের একজনকে একটি দেশীয় লোডেড ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরি সহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। পরে মৃতদেহ গুলোর সুরুতহাল প্রতিবেদন তৈরীর পর ওইদিন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিহতের দাফন করা হয়।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাদ্রাসায় হামলার ঘটনায় এই পর্যন্ত ৬জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদেহ গুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরী ও কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর পুরো ক্যাম্পজুঁড়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা। সৃষ্টি হয়েছে ভীতিকর পরিস্থিতি। ক্যাম্পে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রæপ মাদক, অস্ত্র ও অবৈধ দখলে নিয়ে দোকান ব্যবসা করে আসছে। তারা মানুষ হত্যা করছে এবং জিম্মি করছে। তাই, সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক এজেন্সি একত্রে কাজ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত শরণার্থী, নাগরিক সমাজের কর্মী, রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মীসহ ওই শিবিরে অবস্থানরত মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।
ভয়েস/আআ