রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৬ অপরাহ্ন
মাও. সাইফুল ইসলাম সালেহী:
মরুচারী ও পাহাড়ি কওমে আদ বা আদ সম্প্রদায়ের কোনো কোনো লোকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশত গজ পর্যন্ত। তারা যেমন ছিল সাহসী, তেমনি ছিল শক্তিশালী। তারা ছিল খুব অহংকারী, তাদের অন্তর ছিল খুব কঠিন। তাদের বাসভূমি ছিল ইয়ামান দেশের আহ্কাফ নামক জায়গা। লিখেছেন মাও. সাইফুল ইসলাম সালেহী
হজরত নুহ আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে আদ নামক এক ক্ষমতাশালী বাদশাহ ছিল। তার সমকক্ষ শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ওই যুগে আর কেউ ছিল না। এই বাদশাহ সন্তান-সন্ততির দিক দিয়েও প্রভাবশালী ছিল। তার নামানুসারে তারা কওমে আদ বা আদ বংশীয় নামে ইতিহাসে পরিচিতি। তাদের কোনো কোনো লোকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশত গজ পর্যন্ত। আর মধ্যম শ্রেণির লোকদের উচ্চতা ছিল দুইশত গজ। যারা সবচেয়ে খাটো ছিল, তাদের উচ্চতা ছিল সত্তর গজ। তারা যেমন ছিল সাহসী, তেমনি ছিল শক্তিশালী। তারা ছিল খুব অহংকারী, তাদের অন্তর ছিল খুব কঠিন। তারা সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করত। দুর্বল ও নিরীহ মানুষদের ওপর খুব অত্যাচার করত। তাদের বাসভূমি ছিল ইয়ামান দেশের আহ্কাফ নামক জায়গা। তারা ছিল মরুচারী ও পাহাড়ি লোক। তাফসিরে ইবনে কাসির সাহস ও শক্তির গৌরবে তারা আল্লাহ ও নবীকে ভুলে যায়। তারা সৎ ও ভালো কাজের বদলে দেবদেবীর পূজা শুরু করে। আদ কওমের যখন এমন অবস্থা প্রবল আকার ধারণ করে, তখন তাদের হেদায়েত করার উদ্দেশ্য আল্লাহতায়ালা কওমে আদের মধ্য থেকে হুদ নামক এক ব্যক্তিকে নবীরূপে প্রেরণ করলেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদ জাতির নিকট তাদের ভাই হুদকে নবীরূপে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না?’ সুরা আল আরাফ : ৬৫
হজরত হুদ (আ.) আদ জাতিকে দেবদেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। তখন তারা নবীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে। কোরআন মজিদে এসেছে, ‘তার জাতির নেতারা বলল, আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখছি এবং আমরা তো তোমাকে নিশ্চিতরূপে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে (নবী) বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, বরং আমি হলাম সারা জাহানের রবের মনোনীত রাসুল।’ সুরা আরাফ : ৬৬-৬৭
শক্তিশালী আদ জাতিকে হজরত হুদ (আ.) আল্লাহর সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান এবং আল্লাহর নেয়ামত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য বললেন। কোরআন মজিদে এসেছে, ‘আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি, আর তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাক্সক্ষী তোমরা কি এতে বিস্মিত হচ্ছো যে, তোমাদের জাতিরই একটি মাধ্যমে তোমাদের রবের পক্ষ হতে তার বিধান ও উপদেশসহ তোমাদের কাছে এসেছে? তোমরা সেই অবস্থার কথা স্মরণ করো যখন নুহের সম্প্রদায়ের পর আল্লাহ তোমাদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অন্যদের অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে।’ সুরা আল আরাফ : ৬৮-৬৯
হজরত হুদ (আ.) তাদের অনেকভাবে বোঝালেন ও উপদেশ দিলেন। কিন্তু তারা তার কথা শুনল না। হজরত হুদ (আ.) দীর্ঘদিন ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য চেষ্টা করলেন, মাত্র সত্তরজন লোক তার প্রতি ইমান আনে। তারাও কাফেরদের ভয়ে গোপনে আল্লাহর ইবাদাত করত, প্রকাশ্যে ইবাদাত করতে সাহস পেত না। তারপরও হজরত হুদ (আ.) আদ জাতিকে ধর্মের পথে আহ্বান করতে থাকেন। আর আদ জাতি এভাবে তার উত্তর দিতে থাকে, হুদ! তুমি কি আমাদের কাছে এ আশা করছ যে, আমরা তোমার কথামতো বাপ-দাদার ধর্ম দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে এক খোদার উপাসনা করব? তা তুমি জেনে রাখো, আমরা তোমার খোদার ইবাদত করব না। তুমি যে তোমার খোদার ভয় দেখাচ্ছ, যদি সত্যি হয় তবে তা আমাদের প্রত্যক্ষ করাও না কেন? না হলে আমরা তো তা বিশ্বাস করবই না; বরং আমরা তোমাকে জানে মেরে ফেলব। বিষয়টি কোরআন মাজিদে এসেছে এভাবে, ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে শুধু এই উদ্দেশে এসেছ যে, আমরা যেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের পূজা করত তাদের বর্জন করি? তুমি তোমার কথা ও দাবিতে সত্যবাদী হলে আমাদের যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর।’ সুরা আল আরাফ : ৭১
এক পর্যায়ে হজরত হুদ (আ.) তাদের সম্পর্কে একেবারে নিরাশ হয়ে আল্লাহর দরবারে এরূপ দোয়া করলেন, হে মাবুদ! তারা আমার কথা শুনছে না। বরং আমাকে প্রাণে মরার ভয় দেখাচ্ছে। আমার এমন শক্তি নেই যে, আমি তাদের সঙ্গে পেরে উঠব। তারা অনেক শক্তিশালী। আপনি আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করুন।
হজরত হুদ (আ.) তার সত্তরজন মুমিন উম্মত নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার সময় আরও একবার কাফেরদের সত্যধর্মের প্রতি আহ্বান করে বললেন, এখনো তোমরা আমার কথা মেনে নাও। না হলে কিন্তু অচিরেই তোমরা আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আদ জাতি হজরত হুদ (আ.)-এর কথা শুনে তাকে ঠাট্টা ও বিদ্রƒপ করল। ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের দেশে একাধারে তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখলেন। এ সময় দেশে কোনো ফসলাদি জন্মায়নি। ফলে সারা দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর গজব শুরু হওয়ার আগে হজরত হুদ (আ.) তার উম্মতগণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি লোকালয় ত্যাগ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তাকে (হুদকে) এবং তার সঙ্গী-সাথিদের আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, আর যারা আমার নির্দেশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং যারা ইমাদার ছিল না তাদের মূলোৎপাটন করলাম।’ সুরা আরাফ : ৭২
কিছুক্ষণ পরে ভয়াবহ গজব শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে প্রবলবেগে তুফান শুরু হয় দাম্ভিক আদ সম্প্রদায়ের লোকদের সব দাঁত মুহূর্তে ধূলিস্মাৎ হয়ে ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাদের আশ্রয়স্থান পাহাড়ের গুহায় বায়ু প্রবেশ করে তাদের উড়িয়ে এমনভাবে আছাড় মারে যে, সাত লাখ মানুষের দেহগুলো উৎপাটিত খেজুর গাছের মত নিষ্প্রাণ হয়ে ভূমিতে পড়ে থাকে। তারপর প্রবল বায়ুর তা-ব শুরু হয়, ধুলা মাটি লাশগুলোর ওপর এমনভাবে পড়তে থাকে যে, তাতে দেহগুলো চাপা পড়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আদ সম্প্রদায়, তাদের ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচ- ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা।’ সুরা আল হাক্কাহ : ৬
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি দেখোনি, তোমার রব কি করেছেন আদ বংশের।’ সুরা আল ফাজর : ৬
ভয়েস/আআ