রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২৯ পূর্বাহ্ন
শায়খ আবদুল বারী আস-সুবাইতি:
মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টি ফেরালে যেকোনো মানুষকে বিস্মিত হতে হয়। মহাবিশ্বের মহিমা, সৌন্দর্য, পরিপূর্ণতা, শৃঙ্খলা এবং সামঞ্জস্যতার বিস্ময় ও রহস্য শেষ হওয়ার নয়। কোরআন মাজিদ আসমান ও পৃথিবীর রাজত্ব সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করতে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি যথাযথভাবে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।’ -সুরা আয-যুমার : ৫
আপনি প্রতিদিন একটি নিপুণ বিষয় দেখতে পাবেন, রাত আসে ও দিন যায়, আবার দিন আসে ও রাত প্রস্থান করে অবিরাম চলন ও প্রবাহে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে একদিনও রাত সময়মতো আগমন করতে দেরি করেছে অথবা সূর্য তার নির্ধারিত সময়ের আগেই উদিত হয়েছে। কে বিষয়টি পরিচালনা করছে এবং কে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক এর চলমান তাকে সংগঠিত করছে ও অবিরত আবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করছে?
সৃষ্টি কূলের সবাই মিলে যদি দিনের স্থানে রাত অথবা রাতের জায়গায় দিনকে নিয়ে আসতে সাধনা করে, তারা সক্ষম হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কী, যদি আল্লাহ রাতকে তোমাদের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তার পরিবর্তে কোনো ইলাহ (উপাস্য) আছে কি যে তোমাদের আলো এনে দেবে? তবুও কী তোমরা শুনবে না? বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কী, যদি আল্লাহ দিনকে তোমাদের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তার পরিবর্তে কোনো ইলাহ আছে কি, যে তোমাদের রাত এনে দেবে যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না?’ -সুরা আল-কাসাস : ৭১-৭২
রাত চাঁদের স্নিগ্ধ, শান্ত আলো দিয়ে তার পর্দা টেনে দেয়, স্থিরতা ও প্রশান্তি অর্জনের জন্য। সূর্য একটি দীপ্তিময় প্রদীপ দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করে। যাতে জগতে জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়, হৃদয়ে জীবিকা ও কর্ম নির্বাহের চঞ্চলতা আসে যাতে জীবন সমৃদ্ধ ও জীবিতরা সুখী হয়। অলৌকিকতা ও সৃজনশীলতা উপস্থাপনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।’ -সুরা ইয়াসিন : ৩৮
সূর্যের গতি একটি শান্ত প্রবাহ, যা বিশৃঙ্খলভাবে চলে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর চাঁদের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন কক্ষ; অবশেষে সেটা শুষ্ক বাঁকা পুরনো খেজুর শাখার আকারে ফিরে যায়।’ -সুরা ইয়াসিন : ৩৯
এই মহাবিশ্বের অন্য একটি পৃষ্ঠা রয়েছে যা মস্তিষ্ককে বিমোহিত করে ও বিস্ময় জাগায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই সাগরকে নিয়োজিত করেছেন যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার আর তা থেকে তোমরা রত্নরাজি সংগ্রহ করতে পার যা তোমরা অলংকার হিসেবে পরিধান করো।’ -সুরা আন নাহল : ১৪
কোরআন মাজিদে এই আয়াত ছাড়াও নৌযান এবং সমুদ্র প্রসঙ্গে অনেক বর্ণনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন এবং এটাকে ব্যবহারের জন্য সহজ করে দিয়েছেন; তা নৌযান বহন করতে সক্ষম। তিনি মানুষকে এমন পদ্ধতিতে নৌকা তৈরি শিখিয়েছেন, যা সমুদ্রের ঝড়ে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং তাদের যাত্রার সময় অবিরাম বাতাস ও ঢেউ থেকে তাদের সুরক্ষা দেবে। নিঃসন্দেহে এটি শক্তিমান সত্তার ব্যবস্থাপনা এবং সৃষ্টিকর্তার পরিচালনা পদ্ধতি।
তদ্রƒপ, সবুজ শ্যামল বিস্তৃত জমিনের মনোরম দৃশ্য মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা দেখতে পাই, তৃণলতা জমিনকে অনিন্দ্য সুন্দর রঙে সাজিয়েছে ও উজ্জ্বল ডালপালা দিয়ে আবৃত করেছে। আরও দেখতে পাই, একই পানি দ্বারা সিক্ত রকমারি ফলমূল, যা স্বাদে একটা থেকে অন্যটা আলাদা। এভাবেই মানবতা এমন এক মহাবিশ্বের সামনে বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে, যা অত্যন্ত সৃজনশীল, অলৌকিক এবং নিখুঁত। গবেষণা কেন্দ্রগুলো প্রতিদিন এই মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় নিয়ে অধ্যয়ন-গবেষণা করে এবং আমাদের কাছে এক এক করে প্রকাশ করে নতুন নতুন বিষয়। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো মহাকাশে ঘুরে বেড়ায় এর প্রকৃতি উদঘাটনের জন্য এবং সাবমেরিনগুলো সমুদ্রের গভীরে যাত্রা করেও আশ্চর্যজনক বিস্ময় দেখতে পায়।
সুমহান আল্লাহ মানুষের কাছে মহাবিশ্বের কিছু রহস্য, নিদর্শন এবং প্রতিটি জাতি ও স্থানে এবং প্রতিটি যুগে ও সময়ে তার কর্মের নিপূণতা প্রকাশ করে চলেছেন। যেন পৃথিবীকে সংরক্ষণ ও স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে আল্লাহর অনুগ্রহ যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি। তাই মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার প্রভাবগুলো লক্ষ করে দেখুন। এসব ভূমিকম্প, হারিকেন ও বন্যা মহাবিশ্বে আল্লাহর রীতিগত নিয়মে ঘটে এমন হিকমতের জন্য; যার সারমর্ম আমরা জানি না। তা হলো বিশ্বজগতের পালনকর্তার রহমত, যদিও এটি সৃষ্টির কাছে ভিন্ন মনে হয়। তবে বিজ্ঞান তার কারণ ও রহস্যের কিছু অংশ উদঘাটন করতে পারে। জ্ঞানের পরিধি যত বড়ই হোক না কেন তা অসম্পূর্ণ, আর একজন বিদ্বানের বুদ্ধি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে তো দুর্বল সৃষ্টি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে অতি সামান্যই।’ -সুরা আল-ইসরা : ৮৫
এসব দুর্যোগ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জাতির ওপর আপতিত হওয়াকে তাদের ওপর শাস্তি মনে করা শরিয়তের ওপর মিথ্যা রোপের শামিল। কেননা কখনো বালা-মসিবত আসে সংশোধন করতে অথবা গোনাহ থেকে পবিত্র করতে অথবা তাদের মনোনীত ও সম্মানিত করতে। কখনো এসবগুলো উদ্দেশেও আপতিত হয়। বালা-মসিবতের নানা ধরন ও অবস্থা রয়েছে যা উল্লেখ হয়েছে কখনো তার চেয়ে গুরুতরভাবে মানুষকে পরীক্ষায় ফেলা হয়, যেমন নিরাপত্তাহীনতা, যুদ্ধের তীব্র আওয়াজ, অন্যায়-অবিচারের বিস্তার লাভ এবং হত্যা, মহামারী ও রোগের তীব্রতা।
কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব দুর্যোগ মহামসিবতের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো যাদের ওপর আপতিত হয় তাদের জন্য বিপদ ও পরীক্ষা, আর অন্যদের জন্য সংশোধন হওয়ার মাধ্যম যারা সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও হাত গুটিয়ে রাখে এবং সহায়-সম্পদের মালিক হয়েও দান-সদকা করে না। এসব দুর্যোগ মুসলমানদের মধ্যে করুণা পরিমাপের একটি পরীক্ষা এবং অন্তরে তাদের ভ্রাতৃত্ববোধের মান নির্ণয়ক।
মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তিই মারা যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি পীড়িত ও বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগে পতিত হয় এবং যার মসিবত গুরুতর, তারপর সে ধৈর্য ধারণ করে ও সওয়াবের প্রত্যাশা করে; তার পুরস্কার অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অফুরন্ত। আল্লাহর রহমত তাকে ঘিরে রাখে, আশা করা যায় যে, সে মহা শক্তিমান বাদশা আল্লাহর কাছে উচ্চ স্তরে উচ্চ মর্যাদায় থাকবে। তার ললাট বেয়ে যে অশ্রু প্রবাহিত হয়, তা তার কবরে তার জন্য জ্যোতি হবে এবং প্রিয়জন হারানোর যে দুঃখ তার মধ্যে চেপে বসেছে; তার বিনিময়ে সে অনন্তকালের জান্নাতে আনন্দ, ভালোবাসা ও খুশির পুরস্কার পাবে। আর সে তার হারানো পরিবারের সঙ্গে অচিরেই চিরস্থায়ী জান্নাতে সাক্ষাৎ লাভ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে আসনে অবস্থান করবে, সেখানে তাদের ক্লান্তি স্পর্শ করবে না এবং তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃতও হবে না।’ -সুরা আল-হিজর : ৪৭-৪৮
তা ছাড়া হাদিসে আছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে নিহত ব্যক্তি শহীদ, মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, পক্ষাঘাতে মৃত্যু বরণকারীও শহীদ, পেটের পীড়ায় মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারীও শহীদ এবং প্রসবকালে মৃত্যুবরণকারী মহিলা শহীদ।’
বিনম্র অন্তরগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে, এসব রীতির অন্যতম হেকমত হলো সমগ্র উম্মতকে উপদেশ ও শিক্ষাদান এবং আত্ম সংশোধন, আল্লাহ অভিমুখী হওয়া, অন্যের হক ফিরিয়ে দেওয়া ও নিষ্ঠার সঙ্গে তওবার মাধ্যমে পাপ পরিহার করা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের জাগ্রত করা। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর কেউ জানে না আগামীকাল সে কী অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোনো স্থানে সে মারা যাবে।’ -সুরা লোকমান : ৩৪
অবশ্যই আল্লাহর এসব বাণীকে সতর্ককারীরূপে গ্রহণ করতে হবে। কোরআন মাজিদে এ বিষয়ে বারবার মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। সহিহ বোখারির হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত কায়েম হবে না যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফাতনা প্রকাশ পাবে এবং হারজ বৃদ্ধি পাবে। হারজ অর্থ খুন-খারাবি। আর তোমাদের সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, উপচে পড়বে।’
২৯ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ