রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০২ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ ইউনুছ:
মুমিন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হলো- আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। আর তা করতে হয় ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি জিন ও মানুষ জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’ -সুরা যারিয়াত : ৫৬
দুনিয়া ও পরকালের জীবনে সফল হওয়ার জন্য কবুলযোগ্য ইবাদতের বিকল্প নেই। তবে শিরক, কুফর ও নেফাকমুক্ত বিশুদ্ধ ইমান সব ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত। শুধু তাই নয়, ইবাদত পরিপূর্ণ ইখলাসের (একনিষ্ঠভাবে) সঙ্গে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যের সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলেও ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের সমস্ত কৃতকর্ম নিয়ে আমি ধুলোর মতো উড়িয়ে দেব।’ -সুরা আল ফুরকান : ২৩
অনেকেই বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইবাদত কবুলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপসহ আরও নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে। যেগুলো মানুষের নিত্যদিনের অন্যতম সঙ্গী। এসব যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে আমরা মুহূর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন খবর পাই এবং নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ ও আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজ নিয়ে থাকি। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে কোরবানি, হজ, ওমরাহ, রোজা, নামাজ, দান-খয়রাতসহ ইবাদতকালীন নানা ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করছে মানুষ। যদিও ইবাদতের নিয়ত কিন্তু একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হলেও আমাদের অজান্তেই ইবাদতগুলো আল্লাহর কাছে কবুল হচ্ছে না। অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে কোরবানি করছি, মক্কায় গিয়ে হজব্রত পালন করছি, ওমরাহ করছি, জাকাত আদায় করছি। কিন্তু তার ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড দেওয়ার কারণে শুধু আমাদের সময় এবং টাকা নষ্ট হচ্ছে, ইবাদতের সওয়াব আমরা পাচ্ছি না, এমনকি ফরজও আদায় হচ্ছে না। কারণ ইবাদতে রিয়া থাকার কারণে আল্লাহর কাছে তা কবুল হয় না।
আমরা জানি না, আমাদের অজান্তে এসব ছবি বা ভিডিও আমাদের কত বড় ক্ষতি করছে। কারণ আমাদের অজান্তেই ইবাদতগুলো রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদতে পরগণিত হচ্ছে। ইবাদত করা দেখে অন্য কেউ ভালো বলুক এরূপ মনোভাব নিয়ে ইবাদত করলে প্রকৃত পক্ষে ওই ইবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয় না। এ কারণে রিয়াকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) গোপন শিরক বলেছেন। রিয়ার শাব্দিক অর্থ লোক দেখানো ইবাদত। রিয়া এমনই একটি মানসিক প্রবৃত্তি, যা নেক আমলকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। এ জন্য কেয়ামতের ময়দানে শুধু রিয়াযুক্ত হওয়ার কারণে অনেক মানুষের আমল বরবাদ হয়ে যাবে।
ইসলামের পরিভাষায় রিয়া বলা হয়, সমাজে লোকে ধার্মিক বলে আলাদা সম্মান করবে, কিংবা নিজেকে একটু ভিন্নভাবে লোকজনের কাছে উপস্থাপন করা যাবে, এ উদ্দেশ্য নিজেকে মানুষের সামনে আল্লাহভীরু, পরহেজগাররূপে প্রকাশ করা। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে রিয়ার অপকারিতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবাদতের মধ্যে একটি ধূলিকণা পরিমাণ লোক দেখানো মনোভাব থাকলেও আল্লাহতায়ালা ওই ইবাদত কবুল করবেন না। বরং এর জন্য শাস্তি অবধারিত। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রভুর দর্শন লাভের আশা রাখে, সে যেন নেক কাজ করে এবং তার ইবাদতে যেন অপর কাউকে শরিক না করে।’ -সুরা কাহাফ : ১১০
আমাদের সমাজে অনেক লোক এমন আছে, যারা লোক দেখানোর জন্য আমল করে। তার কথা সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ুক এ প্রত্যাশা করে এবং লোকেরা শুনে বাহবা দিক এ কামনা করে। বাস্তবে যদি কেউ এসব নিয়তে আমল বা কাজ করে তবে সে শিরক তথা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারত্বে নিপতিত হবে। এরূপ বাসনাকারী সম্পর্কে হাদিসে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করা হয়েছে। সাহাবি হজরত মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের ওপর যা ভয় করি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে- শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানো আমল), আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তাদের (রিয়াকারীদের) বলবেন, যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেওয়া হবে, তোমরা তাদের কাছে যাও যাদের তোমরা দুনিয়াতে দেখাতে, দেখো- তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কি না?’ -হাদিসে কুদসি
অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লোক শোনানো ইবাদত করে আল্লাহতায়ালা এর বিনিময়ে তার লোক-শোনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানো ইবাদত করবে আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোক দেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন। -সহিহ বোখারি : ৬৪৯৯
এমনকি যদি কেউ আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের সন্তুষ্টিকল্পে ইবাদত করে তার আমলও বরবাদ হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি অংশীবাদিতা (শিরক) থেকে সব অংশীদারের তুলনায় বেশি মুখাপেক্ষীহীন। যে কেউ কোনো আমল করে এবং তাতে অন্য কাউকে আমার সঙ্গে শরিক করে, আমি তাকে ও তার আমল উভয়কেই বর্জন করি। -সহিহ মুসলিম : ২৯৮৫
উল্লিখিত কোরআনের আয়াত ও হাদিসে আলোকে বুঝা যাচ্ছে, রিয়া অতি মারাত্মক একটি পাপ। ইবাদতের মধ্যে একটি ধূলিকণা পরিমাণ লোক দেখানো মনোভাব থাকলে আল্লাহতায়ালা ওই ইবাদত কবুল করেন না। যেকোনো আমল আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য রিয়া বা লৌকিকতামুক্ত থাকতে হবে। কোরআন হাদিসের নির্দেশিত নিয়মে হতে হবে। মানুষকে দেখানো বা অন্য কোনো স্বার্থের জন্য হতে পারবে না। কেননা যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, সে ছোট শিরক (অংশীদারি) করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে। তখন তার সব আমল বরবাদ হয়ে যাবে। সেটা বড় আমল হোক বা ছোট আমল হোক।
যেমন লোক দেখানো নামাজ, রোজা, ওমরাহ, হজ, জাকাত, দান ইত্যাদি। তবে কেউ না চাইতেই মানুষ তার ভালো কাজ বা ইবাদত দেখে প্রশংসা করলে সেটা রিয়া হবে না। তাছাড়া একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশির জন্য দান-সদকা, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ, পরোপকার, মানুষকে অর্থ-সম্পদ বা বিভিন্নভাবে সহায়তা করলে যদি কারও নাম ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এগুলো রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই দাতার নিয়ত পরিশুদ্ধ হতে হবে। ইবাদতে রিয়া থেকে মুক্ত থাকতে হলে সম্মান, খ্যাতি-প্রীতি ও দেমাগ-ভাব অন্তর থেকে বের করতে হবে। রিয়ার চেতনা এসে গেলেও তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বরং নিয়ত ঠিক রেখে কাজ করে যেতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে সেটা অভ্যাসে পরিণত হবে এবং অভ্যাস থেকে ইবাদতও একনিষ্ঠতায় পরিণত হবে।
ভয়েস/আআ