রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

জ্ঞানচর্চা ও দীনের সেবায় নিয়োজিত এক আলেম

ধর্ম ডেস্ক:
হজরত উমর (রা.) বলেন, আল্লাহর ভালোবাসার একটি চাদর আছে। যে ব্যক্তি জ্ঞানের কোনো একটি অধ্যায় অর্জন করবে, আল্লাহ তার দেহে সেই চাদর পেঁচিয়ে দেবেন। সেই ভালোবাসার চাদরের অধিকারী হওয়া সহজ কথা নয়, এজন্য দরকার সাধনা। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবনে সাধক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন মাওলানা আবদুল আলী। তার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে লিখেছেন আবদুল আউওয়াল

মানুষ জ্ঞানবান প্রাণী। জ্ঞানই তাকে শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করিয়েছে। জ্ঞান আহরণের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম অধ্যয়ন। অধ্যয়ন মানেই জ্ঞানের চর্চা। জ্ঞানচর্চায় যিনি পথ দেখান ও জ্ঞান বিতরণ করেন তিনি শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষক আদর্শ জাতি গঠনের মূল কারিগর। তাই শিক্ষকতাকে একটি মহৎ ও পবিত্র দায়িত্ব মনে করা হয়। এ দায়িত্ব যারা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন তাদেরও সমাজে মহৎ ও উৎকৃষ্ট ভাবা হয়। এমনই একজন গুণধর ব্যক্তিত্ব শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল আলী। অধ্যাপনা করছেন ৫০ বছর ধরে। হাদিসের সর্বোচ্চ বিশুদ্ধগ্রন্থ সহিহ বোখারি পড়াচ্ছেন প্রায় ৩০ বছর ধরে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও ক্লান্ত নন তিনি। এখনো পড়াচ্ছেন ফুরফুরে মেজাজে। ইলমের সুঘ্রাণে মোহিত করছেন ছাত্রদের হৃদয়জগৎ।

চলা-বলায় অতি সাধারণ এই মনীষী জীবনে পড়িয়েছেন বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানে। ১৯৭৪ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারের বড় কাটারায় অবস্থিত ‘জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম’ মাদ্রাসা থেকে ফারেগ হয়ে ১৯৭৫ সালে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায়। সেখানে পড়ান ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। এরপর নিজের পড়ালেখা করা প্রিয় প্রতিষ্ঠান বড় কাটারা মাদ্রাসায় পড়ানোর ডাক পান। প্রিয় ওস্তাদ (ইমামুন নাহু ওয়াস সরফ হিসেবে খ্যাত) মাওলানা রোকনুদ্দিন (রহ.) স্বয়ং কিশোরগঞ্জ এসে তাকে নিয়ে যান। সেখানে ১৯৮২-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনার কাজ করেন। সহিহ বোখারি, সহিহ মুসলিম ও সুনানে আবু দাউদের মতো মাদ্রাসা সিলেবাসের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির দরস প্রদান করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাদ্রাসায় গোলযোগ দেখা দিলে পড়ালেখার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ব্যাহত হতে থাকে।

এদিকে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে অবস্থিত ‘জামিয়া আরাবিয়া নুরুল উলুম’ মাদ্রাসাটিতে দাওরা হাদিস খোলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বোখারি শরিফ পড়ানোর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক না পেয়ে মাদ্রাসা কর্র্তৃপক্ষ তার দ্বারস্থ হয় এবং সেখানে আসার অনুরোধ জানায়। তিনি সে অনুরোধ রক্ষা করেন এবং ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত কুলিয়ারচরে পাঠদান করেন। এরপর মাওলানা মাহমুদুল হাসান (যাত্রাবাড়ী)-এর বিশেষ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বি-বাড়িয়ার বিজেশ^রে অবস্থিত ‘জামিয়াতুস সুন্নাহ’য় শায়খুল হাদিস পদে নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, এ মাদ্রাসাটিও তার দ্বারাই দাওরা হাদিসের ক্লাস শুরু করে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেখানে পাঠদান করেন। দুর্ভাগ্যবশত এখানেও মাদ্রাসা নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। তখন যাত্রাবাড়ী হুজুরের পরামর্শে ঢাকা গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অবস্থিত ‘খাইরুল মাদারিস’ চলে যান। সেখানেও তার দ্বারাই দাওরা হাদিস খোলা হয় এবং ২০২১ পর্যন্ত তিনি সেখানে বোখারি পড়ান। এরপর পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে চলে আসেন আবার কিশোরগঞ্জের ‘জামিয়া ইমদাদিয়া’য়। কিন্তু রিজিক যেন দৌড়াচ্ছিল। দ্বিতীয়বার ঢুকে সেখানে মাত্র এক বছর (২০২২-২০২৩ সেশন) ছিলেন। এদিকে কুলিয়ারচরের আরেক উদীয়মান সাড়াজাগানো প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়া সিদ্দিকিয়া বেতিয়ারকান্দি’ দাওরা হাদিস খোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হজরতকে শায়খুল হাদিস পদ অলঙ্কৃত করার আমন্ত্রণ জানালে তিনি সাদরে তা গ্রহণ করেন। তার দর্শন হলো, অনগ্রসর মাদ্রাসাগুলোকে এগিয়ে নেওয়া। সুতরাং কোন মাদ্রাসা বড় আর কোনটি ছোট, কোনটি শহরে আর কোনটি গ্রাম-মফস্বলে তা তিনি দেখেন না। নিজেকে ইলমের চর্চায় নিয়োজিত রাখা ও দীনের খেদমতে বিলিয়ে দেওয়াকেই শ্রেষ্ঠ কৃতত্ব মনে করেন।

দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে তার হাজার হাজার ছাত্র ও ভক্ত-অনুরাগী। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী (প্রধান পরিচালক বেফাক) মাওলান শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল (পীর সাহেব কিশোরগঞ্জ) ও মুফতি সাঈদ নুর (পীর সাহেব মানিকগঞ্জ)-এর মতো খ্যাতিমান আলেমরা আছেন তার ছাত্রের তালিকায়। সত্তরোর্ধ্ব বয়োবৃদ্ধ এই আলেমের একান্ত আশা ও আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস যেন দরসের মসনদেই হয়। অধ্যাপনার দায়িত্বকে তিনি এতটাই মনেপ্রাণে নিয়েছেন যে, চরম অর্থ সংকটেও তা পরিহার করে অন্য পেশায় জড়িত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বারবার। বড় কাটারায় শিক্ষক থাকাকালে তিনি মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.)-এর মতো লেখক ও পাবলিশালের সঙ্গে থেকে কিছু অনুবাদের কাজ করেছেন। তখন শিক্ষকতা ছেড়ে অনুবাদের কাজে জড়িত হতে একাধিকবার প্রস্তাব পান। কিন্তু শিক্ষকতা ছেড়ে সে কাজে যেতে তিনি আগ্রহী হননি। জীবনে তাই অর্থ-সম্পদও কিছু করতে পারেননি। এখনো বসবাস করেন ভাড়া বাড়িতে। দিন চলে মাদ্রাসা বোর্ডিংয়ের ডাল-ভাত খেয়ে। ‘দুনিয়ায় থাকো মুসাফির কিংবা ভিনদেশির মতো’ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ অমূল্য বাণী যেন এ নায়েবে নবীর জীবনে প্রচ্ছদ হয়ে আছে।

এই গুণী মনীষীর জন্ম ১৯৫২ সালের ৬ অক্টোবর, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ভাস্করখিলা গ্রামের অতি সাধারণ মুসলিম পরিবারে। পিতা আবদুর রহিম ও মাতা আমিরুন্নিসার ৬ ছেলে ও ১ মেয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ তিনি। বড় হয়েছেন চরম অর্থ-দৈন্যের মধ্য দিয়ে। বাবা সংসার চালাতেন সামান্য কৃষিকার্য নির্বাহ করে। পড়ালেখায় আসেন ৬ বছর বয়সে। নিজ গ্রামের ‘মিসবাহুল উলুম’ তার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়ালেখা করে প্রাথমিক স্তর শেষ করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে প্রিয় মুরব্বি, মৌলভি আবদুল আউয়াল (মিসবাহুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও আবদুল ওয়াহাব পীরজি হুজুরের খাস মুরিদ)-এর পরামর্শে চলে যান ঢাকার বড় কাটারা মাদ্রাসায়। মিজান জামাত থেকে দাওরা হাদিস পর্যন্ত সেখানেই পড়ালেখা করেন। প্রচ- মেধাবী, প্রচুর পরিশ্রমী ও নিয়মিত ছাত্র হওয়ার সুবাদে ছাত্র জামানাতেই নজর কাড়েন ওস্তাদদের। সব ক্লাসেই পরীক্ষায় হতেন প্রথম। সে হিসেবেও সুনাম ছিল মাদ্রাসাজুড়ে।

পড়ালেখার প্রতি ছোটবেলা থেকেই অত্যধিক আগ্রহ ছিল। সে আগ্রহ আর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহই তাকে ইলমের মুকুট পরিয়েছে। নতুবা সামাজিক নানা কুসংস্কারঘেরা অজপাড়াগাঁয়ে টানাপোড়েনের সংসারে জন্মগ্রহণ করে বিচক্ষণ আলেম হওয়া তো দূরের কথা শিক্ষার আলো পাওয়াটাই কঠিন ছিল। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার তাকাদা ছিল বড় সন্তান হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে সংসারের হাল ধরার। কিন্তু ইলমের প্রতি প্রবল বাসনাই তাকে সবকিছু অগ্রাহ্য করতে বাধ্য করে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মাদ্রাসায় চরম খাদ্যসংকট দেখা দেয়। তখন কখনো সামান্য রুটি খেয়ে কখনো না খেয়ে পড়ালেখা করেছেন। বাবা তখন পড়ালেখা ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়ার জোর তাগিদ দেন। কিন্তু তিনি ইলমের কাছে তখন অপারগ। বাবাকে জানাতে বাধ্য হলেন, পড়ালেখা ছেড়ে এখন কাজে যাওয়া সম্ভব নয়! এ যেন ইলমের বাগানে অতৃপ্ত ভ্রমর। ছেলের প্রচ- আগ্রহ দেখে বাবা আর কিছুই বলেননি। সেই থেকে বইপোকা মানুষটি বইয়ের পাতাতেই সময় কাটাতে থাকেন। হয়ে ওঠেন ইলমের কাননে প্রস্ফুটিত গোলাপ। আজও আছেন বইয়ের সঙ্গেই। ছাত্রদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলে থাকেন, ‘দাওরা পর্যন্ত যেসব কিতাবাদি পড়ানো হয় তা হলো ইলমের সীমাহীন দরিয়ায় প্রবেশের পথ মাত্র। এ পথে প্রবেশ করে গভীর থেকে গভীরে যেতে হবে।’

ছাত্রজীবনে ওস্তাদদের প্রতি ছিল তার অগাধ ভক্তি-শ্রদ্ধা। সংস্রব পেয়েছিলেন অনেক বুজুর্গ আলেমের। পেয়েছিলেন অনেক যোগ্যবান ওস্তাদও। ইসলাহি সম্পর্ক ছিল প্রথমে থানভি (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা মাসিহুল্লাহ খান (রহ.)-এর সঙ্গে। তার ইন্তেকালের পর হাকিম শাহ আবরারুল হক হারদুঈ (রহ.)-এর সঙ্গে। পরবর্তী সময় শায়খে যাত্রাবাড়ীর মাধ্যমে খেলাফত প্রাপ্ত হন।

ব্যক্তিজীবনে খুবই সাদামাটা ও অনাড়ম্বর সৎপুরুষ। সংসার জীবনে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক তিনি। সবাই আলেম হয়েছেন। বড়ছেলে লেখক, অনুবাদক ‘মুহাম্মদ মুস্তাজাব আল খলিল’ একজন মাদ্রাসাশিক্ষক। মেজ ছেলে মুহাম্মদ মুজতাবা জামিল ওয়ায়েজ ও মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস। ছোট ছেলে মুফতি মুর্তাজা শাকিল মহিলা মাদ্রাসার পরিচালক।

অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখার প্রতিও তার আগ্রহ ছিল। লিখতেনও মাসিক মদিনাসহ কয়েকটি সাময়িকীতে। আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় দখল থাকার সুবাদে দক্ষ অনুবাদকও হয়ে উঠেছিলেন। কওমি ও আলিয়া নেসাবের অনেক কিতাব তিনি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু অতি সরলতার কারণে নিজের সম্পদ ধরে রাখতে পারেননি। তবে কিছু কিছু কিতাবে তার নাম এখনো রয়েছে। মরণের পর কী হবে, দুরুসুল বালাগাত (বাংলা), উর্দু ব্যাকরণ, শরহে মিয়াতে আমেল (বাংলা), প্রশ্ন-উত্তরে হেদায়েতুন্নাহ ও মাবাদিউল আরাবিয়্যাহ ইত্যাদি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি জ্ঞানপ্রিয় এই মানুষটি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে জ্ঞানের সৌরভ বিলিয়ে যাক!

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION