রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন
ইকরামুল ইসলাম:
মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এঁটে দিয়েছে ইসলাম। সম্পর্কের এই জায়গা থেকে একে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা, বিবাদমান বিষয় মিটিয়ে দেওয়া, বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানো এবং সর্বদা কল্যাণ কামনা ইত্যাদি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। যথা এক. কারও সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেবে। দুই. দাওয়াত দিলে কবুল করবে। তিন. পরামর্শ চাইলে সৎ পরামর্শ দেবে। চার. হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে তার জবাব দেবে। পাঁচ. অসুস্থ হলে দেখতে যাবে এবং ছয়. ইন্তেকাল করলে জানাজা-দাফনে অংশগ্রহণ করবে।’সহিহ বোখারি : ১২৪০
সাক্ষাতে সালাম দেওয়া : এক মুসলিমের অন্য মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় যে অভিবাদন জানানো হয়, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হয়, পরিভাষায় তাকে সালাম বলে। সালাম সম্মানজনক অভ্যর্থনামূলক বাক্য। যা আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম হজরত আদম (আ.) কে শেখানোর মাধ্যমে তার বান্দাদের উপহার দেন। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবনে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে ছোট্ট এ শব্দে। আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়াসহ জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করে সালাম। সালামের মাধ্যমে গোনাহ মাফ ও সওয়াব অর্জিত হয়। পারস্পরিক ভালোবাসা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি স্থাপনসহ ব্যক্তিকে অহংকারমুক্ত রাখতে সাহায্য করে সালাম। সালাম প্রদানে ‘সংকোচ’কে কার্পণ্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে হাদিসে। বাড়িতে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সালাম দেওয়া। ছোট-বড় একে-অপরকে সালাম দেওয়া। পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া। তবে সালামের অশুদ্ধ উচ্চারণ এবং বিকৃত উপস্থাপন ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
দাওয়াত দিলে গ্রহণ করা : পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি রক্ষায় দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) প্রদান ও গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে ইসলাম সর্বোচ্চ তাগিদ দিয়েছে। আন্তরিকতার সঙ্গে দাওয়াত দেওয়া, আগত মেহমানকে হাসিমুখে স্বাগত জানানো, খাবার পরিবেশনে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং বিদায় মুহূর্তে মেহমানকে সামনে এগিয়ে দেওয়া; এগুলো মেজবানের দায়িত্ব। মেহমানের কর্তব্য অনৈতিক ও শরিয়াহ কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে দাওয়াত কবুল করা, ধনী-গরিব সবার দাওয়াতকে সমান গুরুত্ব দেওয়া, মেজবানের অনুমতি ছাড়া খাবার দস্তরখানে নিজের সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক না করা, খাবার ও পরিবেশনের দোষ-ত্রুটি না খুঁজে যথাসম্ভব খাবারের স্বাদ ও মেহমানদারির প্রশংসা করা এবং আল্লাহর শোকর আদায় করা। অমুসলিমের দাওয়াত প্রদান-গ্রহণ কিছু শর্ত সাপেক্ষে যদিও ইসলাম বৈধতা দিয়েছে, তারপরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং মেহমানকে খুশি করতে অথবা নিজের সুনাম-সুখ্যাতি বাড়তে অতিরঞ্জন ও অপচয় থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলমানের একান্ত কর্তব্য।
সৎ পরামর্শ দেওয়া : জীবনকে সুষ্ঠুভাবে ও সঠিক পথে পরিচালিত করতে অভিজ্ঞদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য অনভিজ্ঞরা অভিজ্ঞদের শরণাপন্ন হয় নানা বিষয়ে পরামর্শের জন্য। এ ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা খুবই সাবধানতা ও সতর্কতার সঙ্গে পরামর্শ দেবে এবং পরামর্শকে আমানত হিসেবে নিয়ে অধিক কল্যাণকর বিষয় প্রাধান্য দেবে। অকল্যাণকর ও অপছন্দনীয় বিষয় পরামর্শ গ্রহীতার ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাবে। নিজের পছন্দনীয় বিষয় অন্যের জন্যও পছন্দ করবে। তবে কোনো দোষ-ত্রুটি সংশোধনে পরামর্শ দিতে প্রকাশ্য ও জনসম্মুখ পরিহার করে একান্ত ও গোপনীয়তাকে বেছে নেবে। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে গোপনে উপদেশ দেয়, সে যেন তাকে সংশোধন ও সুন্দর করল। আর যে ব্যক্তি তাকে প্রকাশ্যে উপদেশ দেয়, সে যেন তাকে অসম্মান ও দোষী সাব্যস্ত করল।’ ইয়াহইয়া উলুমিদ্দিন : ২/১৮২
হাঁচির জবাব দেওয়া : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা হাঁচি দেওয়া পছন্দ করেন। আর হাই তোলা অপছন্দ করেন। যদি তোমাদের কেউ হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তবে প্রত্যেক মুসলিম শ্রোতার তার জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা ওয়াজিব। আর হাই শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। কাজেই তোমাদের কোনো ব্যক্তির হাই উঠলে সে যেন তা যথাসম্ভব রোধ করে। কেননা, কেউ হাই তুললে শয়তান তার প্রতি হাসে।’ সহিহ বোখারি : ৬২২৬
হাঁচি যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে হাঁচি দেওয়ার সময় মুখ নিচের দিকে এবং নাক রুমাল বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করা।
অসুস্থকে দেখতে যাওয়া : একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় অসুস্থ ও বিপদের সময়। বিপদকালীন যারা পাশে থাকে, অর্থ-সময় ও সাহস দিয়ে সহযোগিতা করে তাদের কখনো ভুলা যায় না। তবে অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, তার সেবা, সুস্থতার জন্য দোয়া ও সান্ত্বনা দেওয়া এটা কেবল এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের দায়িত্ব নয়, এটা ইবাদত ও সওয়াবের কারণ। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেউ সকালে কোনো রোগী দেখতে এলে, সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর রাতে দেখতে এলে, সত্তর হাজার ফেরেশতা সকাল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ফলদ বাগান তৈরি হয়।’ সুনানে তিরজিমি : ৯৬৯
জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ করা : মুসলিম সমাজে কেউ মারা গেলে অন্যদের কর্তব্য ‘ইন্না লিল্লাহ’ পাঠ করা, মৃতকে সুন্দরভাবে গোসল দেওয়া, সুন্নাহ মোতাবেক জানাজা ও দাফন কার্যসম্পন্ন এবং মাগফিরাতের দোয়া করা। হজরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো মৃতের দাফনকার্য শেষ করতেন, তখন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবিদের বলতেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমার দোয়া করো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো তিনি যেন তাকে ইমানের ওপর দৃঢ় ও অবিচল রাখেন। কেননা, তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ সুনানে আবু দাউদ : ৩২২১
ভয়েস/আআ