শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ অপরাহ্ন
বিলাল হোসেন মাহিনী:
শান্তির জন্য দরকার সহমর্মিতা ও সহানুভূতি। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও পরমতসহিষ্ণুতা ছাড়া শান্তি আনয়ন সম্ভব নয়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি আনা যায় না। শান্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধির জন্য যেসব কাজ হুমকিস্বরূপ তা ইসলামে নিষিদ্ধ। বিশেষত জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং মানুষের প্রাণ, ধন-সম্পদের ক্ষতি হয় এমন সহিংস ও বিধ্বংসী যেকোনো কাজ ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ ‘ফাসাদ’ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সহিংস রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কাজগুলো এর অন্তর্ভুক্ত।
ফাসাদের অর্থ : ইসলামে নিষিদ্ধ ফাসাদের অর্থ শান্তি ও কল্যাণ পরিপন্থী কাজ। মানুষের জন্য কল্যাণকর নয় জেনেও কোনো কাজ করলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে ফাসাদ এবং তা নিষিদ্ধ। ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেন, ফাসাদ হলো, ‘কোনো জিনিসের কল্যাণকর অবস্থা পাল্টে দেওয়া।’ অর্থাৎ স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা পাল্টে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। -নুজহাতুল আয়ুন, পৃষ্ঠা ৪৬৯
ফাসাদের চেয়ে গুরুতর ইফসাদ, তা হলো- মন্দ উদ্দেশ্যে কোনো বিষয়কে স্বাভাবিক ও কল্যাণকর অবস্থা থেকে বের করে অস্বাভাবিক ও ভীতিকর অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া। -আল কুল্লিয়াত, পৃষ্ঠা ২২০
সুতরাং সহিংস ও বিশৃঙ্খল আচরণ, কর্মকা- ও কর্মসূচি ফাসাদ ও ইফসাদের অন্তর্ভুক্ত। সহিংসতা কোনো মুমিন-মুসলমানের কাজ নয়। পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে সহিংসতা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণগুলো হলোজ্বা
আল্লাহ সহিংসতা অপছন্দ করেন : আল্লাহ সহিংস ও ধ্বংসাত্মক কাজ পছন্দ করেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়; আল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্তদের ভালোবাসেন না।’ -সুরা মায়িদা : ৬৪
সহিংস ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত : যারা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে দেশ ও জাতির ক্ষতি করতে চায়, শেষ পর্যন্ত তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ -সুরা বাকারা : ২৭
সহিংসতা মুনাফিকদের কাজ : পবিত্র কোরআনে সহিংসতাকে মুনাফিক বা কপট লোকদের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কোরো না, তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! তারাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।’ -সুরা বাকারা : ১১-১২
কল্যাণের পরিপন্থী : সহিংসতা সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করে, যা কল্যাণের পরিপন্থী কাজ। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না, তাকে (আল্লাহকে) ভয় ও আশার সঙ্গে ডাকবে।’ -সুরা আরাফ : ৫৬
সহিংসরা কল্যাণকামী নয় : যারা সমাজে সহিংসতা সৃষ্টি করে তারা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকামী নয়। কেননা কল্যাণকামিতা ও সহিংসতা কখনো এক হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ জানেন কে কল্যাণকামী এবং কে অনিষ্টকারী।’ -সুরা বাকারা : ২২০
ক্ষমতার জন্য সহিংসতা বেশি নিন্দনীয় : ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত হওয়া আরও বেশি নিন্দনীয়। যারা এমন করবে পরকালে তাদের কোনো অংশ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘এটা আখেরাতের সেই আবাস, যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা এই পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম আল্লাহভীরুদের জন্য।’ -সুরা কাসাস : ৮৩
আইন প্রয়োগের অধিকার : যারা সহিংসতা-অস্থিরতার মাধ্যমে দেশ ও সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করতে যায় এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ নষ্ট করে, তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের অধিকার আছে রাষ্ট্রের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে…।’ -সুরা মায়িদা : ৩৩
তবে রাষ্ট্র সংযত আচরণ করবে : সহিংসতারোধে ইসলাম রাষ্ট্রকে আইন প্রয়োগের অধিকার দিলেও তা প্রয়োগে সংযত ও সচেতন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যেন তারা নিজেরাই সহিংস হয়ে না ওঠে এবং প্রতিপক্ষকে দমন করতে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার না করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে (কি) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে।’ -সুরা মুহাম্মদ : ২২
রাষ্ট্র অসংযত হলে বিপর্যয় অনিবার্য : সাধারণ মানুষ অসংযত ও সহিংস হলে যতটা ক্ষতি হয়, রাষ্ট্র সহিংস আচরণ করলে ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যায়। পবিত্র কোরআনে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অপদস্থ করে।’ -সুরা নামল : ৩৪
সহিংসতা রোধে আমাদের করণীয় : সাধারণ নাগরিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা রোধে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে পারে। তা হলো-
সচেতনতা তৈরি : সহিংসতারোধে সাধারণ মানুষ নিজে সচেতন থাকবে এবং অন্যকেও সাবধান করবে নতুবা সমাজের বিপর্যয় রোধ করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের পূর্বযুগে আমি যাদের রক্ষা করেছিলাম তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছাড়া সজ্জন ছিল না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাতে নিষেধ করত।’ -সুরা হুদ : ১১৬
সহিংসতা রোধে সহযোগিতা করা : সমাজ ও রাষ্ট্রে সহিংসতা রোধে কল্যাণকামীরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। কেননা আল্লাহ কল্যাণের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎকাজ ও আল্লাহভীতিতে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনে পরস্পরকে সাহায্য করবে না।’ -সুরা মায়িদা : ২
আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া : মুমিন সর্বোপরি দেশ ও জাতির শান্তি, কল্যাণ ও স্থিতি কামনা করে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করো।’ -সুরা আনকাবুত : ৩০
ভয়েস/আআ