শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

উত্তম চরিত্রই শ্রেষ্ঠ সম্পদ

শায়খ সালাহ বিন মুহাম্মাদ আল বুদাইর:
উত্তম চরিত্র হলো- গরিবদের সমৃদ্ধি, ধনীদের শোভা এবং সুখী মানুষের অলংকার। যার চরিত্র ভালো, তার জীবিকা হবে অঢেল। আর যার চরিত্র খারাপ, তার সঙ্গহীনতা শোভনীয়। কত সাধারণ ব্যক্তি রয়েছে- যার চরিত্র তাকে মহান করেছে, আর কতক সম্মানীকে তার কদর্যতা তাকে হেয় করেছে। বস্তুত যার চরিত্র সুন্দর হয় সে অন্যদের স্বস্তি দেয়, নিজে স্বাচ্ছন্দ্যময় থাকে এবং অন্যেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। হজরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যেখানেই থাকো, আল্লাহকে ভয় করো, মন্দ কাজের পরপরই ভালো কাজ করো, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে। আর মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো।’ -সুনানে তিরমিজি

আল্লাহর রাসুল (সা.) উজ্জ্বল চেহারা ও মার্জিত চরিত্রের পাশাপাশি আল্লাহ প্রদত্ত সুন্দর গুণাবলি, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশুদ্ধ নৈতিকতা ও উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে উত্তম চরিত্রের পথনির্দেশ এবং অসচ্চরিত্র থেকে মুক্তি চেয়ে দোয়া করতেন। হজরত আলি বিন আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন বলতেন, (উচ্চারণ) ‘ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস্ সামাওয়াতি ওয়াল-আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়া ইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, লা শারিকালাহু ওয়া-বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা আনতাল মালিকু লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আনতা রাব্বি ওয়া আনা আবদুকা, জালামতু নাফসি ওয়া-তারাফতু বিজামবি, ফাগফিরলি জুনুবি জামিয়া; ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা, ওয়াহদিনি লি আহসানিল আখলাকি লা ইয়াহদি লি আহসানিহা ইল্লা আনতা, ওয়াসরিফ আননি সাইয়িয়াহা লা ইয়াসরিফু আননি সাইয়িয়াহা ইল্লা আনতা, লাব্বাইকা ওয়া সাদাইকা ওয়াল খাইরু কুল্লুহু ফি ইয়াদাইকা, ওয়াশ শাররু লাইসা ইলাইকা, আনা বিকা ওয়া ইলাইকা, তাবারাকতা ওয়া তালাইতা, আসতাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।’

অর্থ : ‘একনিষ্ঠ হয়ে আমার চেহারা অভিমুখী করলাম ওই সত্তার দিকে, যিনি আসমান ও জমিনসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মৃত্যু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য; যার কোরো শরিক নেই। আর আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলিমদের একজন। হে আল্লাহ! আপনিই বাদশাহ, আপনি ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ (উপাস্য) নেই, আপনি আমার প্রতিপালক এবং আমি আপনার বান্দা। আমি নিজের ওপর জুলুম করেছি এবং আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি। অতএব আপনি আমার সব গোনাহ মাফ করে দিন। আপনি ছাড়া আর কেউই ক্ষমা করতে পারে না। আর আমাকে উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করুন, আপনি ছাড়া কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে না এবং মন্দ চরিত্র থেকে আমাকে দূরে রাখুন। মন্দ চরিত্রগুলো আপনি ছাড়া কেউ আমার থেকে সরাতে পারে না। আপনার কাছে আমি হাজির! আনুগত্য আপনারই জন্য নিবেদিত! সব কল্যাণ আপনারই হাতে, অকল্যাণ আপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমি আপনার ওপর নির্ভরশীল এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। আপনি বরকতময়, মহামহিম, আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তওবা করছি।’ -মুসলিম : ৯০০

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তার নবীর ওই দোয়া কবুল করেছেন। ফলে ওইসব উত্তম চরিত্রের সবই তার মধ্যে সন্নিবেশিত করেছেন, যা বিশ্ববাসীর মধ্যে বিক্ষিপ্তরূপে ছিল। এমনকি আল্লাহ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’

উত্তম চরিত্র সুস্থ বিবেকের ফল। যার কথাবার্তা কোমল ও আচরণ সুন্দর হয়, তাকে ভালোবাসা আবশ্যক হয়ে পড়ে, তার প্রতি আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়, তার সঙ্গ সন্তোষজনক হয়, লোকমুখে তার প্রশংসা উচ্চারিত হয় এবং তার সুন্দর ও ভালো বিষয়গুলো চর্চিত হয়। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার প্রিয়তম এবং কেয়ামতের দিন অবস্থানে আমার নিকটতম হবে সেই লোক যে তোমাদের মধ্যে চরিত্রে শ্রেষ্ঠতম।’ -সুনানে তিরমিজি

সচ্চরিত্র হলো- যাবতীয় হক আদায় করা, দয়া করা, সৎকাজ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখা, অন্তর পরিচ্ছন্ন রাখা, সুন্দর ব্যবহার করা, সত্য কথা বলা, ন্যায়বিচার করা, ওজর কবুল করা, ক্ষমা করা, সহযোগিতা করা, উদারতা দেখানো, পাপের কাজ পরিত্যাগ করা, ভালো গুণে গুণান্বিত হওয়া। আর মানুষের বিষয়াবলি নিয়ে সমালোচনা, তাদের দোষ খোঁজ করা, তাদের কথা ও কাজের বর্ণনা এবং তাদের গোপনীয়তা অনুসন্ধান করা থেকে বিরত থাকা, কঠোরতা, অভদ্রতা, দুর্ব্যবহার, এবং ভ্রƒ কুঞ্চিত করা পরিত্যাগ করা, তাড়াহুড়া, সহিংসতা ও অস্থিরতা পরিহার করা। যে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা এবং যে জুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করা, অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন।’ -সুরা আল আরাফ : ১৯৯

হজরত জাফর (রা.) বলেন, উত্তম চরিত্রের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় কোরআন মাজিদের উপরোক্ত আয়াত অপেক্ষা অন্য কোনো আয়াত নেই। হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উত্তম চরিত্রের প্রকাশ ঘটে তিনটি কাজে- নিষিদ্ধ জিনিসগুলো এড়িয়ে চলা, হালাল অন্বেষণ করা এবং নিজের পরিবার-পরিজনের প্রতি উদার হওয়া। হজরত আবদুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.) বলেন, তা হলো- প্রফুল্ল থাকা, ভালো কাজ করা ও কষ্টদায়ক বস্তু থেকে বিরত থাকা। উত্তম চরিত্র সম্পর্কে ইমাম আহমাদ (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, রাগান্বিত হয়ো না এবং উত্তেজিত হয়ো না।

কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন, উত্তম চরিত্র হলো- মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করা, তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের কষ্ট সহ্য করা ও তাদের প্রতি সহনশীল হওয়া, কষ্টের সময় তাদের সঙ্গে ধৈর্য ধারণ করা এবং অহংকার ও জুলুম করা থেকে বিরত থাকা। কঠোরতা, রাগ ও তিরস্কার বর্জন করা।

উত্তম চরিত্র ও উচ্চ সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি কোনো নিকৃষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, মূর্খ ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করে না, কঠোর ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয় না এবং তার বন্ধুদের দোষারোপ করে না। আর যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে আর তার সেবা-যতœ না করা হয়, অথবা কোনো কাজে সুপারিশ প্রার্থনা করলে সাড়া না দেওয়া হয়, অথবা কোনো মজলিসে প্রবেশ করলে তার সম্মান না করা হয় অথবা কোনো কথা বললে তার কথা শোনা না হয় তাহলে সে বিরক্ত হয় না, রাগান্বিত হয় না এবং কাউকে তিরস্কার করে না, তার ভাইদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে না এবং মানুষের কাছে বলে বেড়ায় না যে, তিনি অমুকের পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার পেয়েছেন, অমুকের দ্বারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং অমুকের দ্বারা জুলুমের শিকার হয়েছেন। বরং সে এগুলোর মোকাবিলা করে এমন কিছু দিয়ে যা হয় মধুর, উত্তম ও মহৎ এবং হেকমত, করুণা, ক্ষমা এবং উদারতার অধিক নিকটবর্তী।

আল্লাহর রাসুল (সা.) ক্ষমা করতেন, রূঢ় আচরণ ও ত্রুটির জন্য ধৈর্য ধারণ করতেন, মূর্খ ব্যক্তির সঙ্গে সহনশীল থাকতেন, তার প্রতি দয়া করতেন, সদয় হতেন এবং তাকে দান করতেন, যদিও সে অশ্লীলভাবে চাইত এবং কথায় ও আচরণে খারাপ করত। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) অশ্লীল ভাষী ও অসদাচারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম।’ -সহিহ বোখারি

মুমিন ব্যক্তি উত্তম চরিত্র, সদাচরণ, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থেকে এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চ ও সম্মানজনক মর্যাদায় পৌঁছতে পারে। অসৎ চরিত্র, রূঢ় আচরণ, ঝগড়া-বিবাদ করা, কঠোর ব্যবহার ও বদমেজাজ হলো লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার নির্দেশক। যে ব্যক্তির চরিত্র খারাপ হয়, অহংকার বেশি হয়, নিজেকে ভালো মনে করে এবং অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়, অনুতাপ দীর্ঘ হয় এবং সম্মান হারিয়ে যায়। রূঢ়ভাষী, ঝগড়াটে, দংশক, সংকীর্ণমনা ও নির্দয় লোক যে মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, অহংকার করে, তাদের দিকে বক্রদৃষ্টিতে তাকায়, তাদের মধ্যে গর্বের সঙ্গে চলে, তাদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকায় না, তার চরিত্র তাদের মুগ্ধ করে না এবং অন্যের কোনো হক ও মর্যাদাকে স্বীকার করে না সে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে যায় এবং মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।

সুতরাং আপনারা হীন, ইতর, ছোটলোক ও নিচ ব্যক্তির চরিত্র থেকে সতর্ক থাকুন। চরিত্র সৃষ্টিগত স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য, তবে তা আচার-আচরণ, কষ্ট ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। অনুরূপভাবে সাহচর্য গ্রহণ ও মেলামেশার মাধমে অর্জিত হয় এবং পরিমার্জন ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে তা অভ্যাসে পরিণত হয় এমনকি তা যোগ্যতা ও স্বভাবে রূপান্তরিত হয়। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় জ্ঞান শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হয়, আর ধৈর্যের মাধ্যমে সহনশীলতা অর্জিত হয়, যে কল্যাণ অনুসন্ধান করে তাকে তা দেওয়া হয় আর যে অকল্যাণ থেকে মুক্তি পেতে চায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।’ -মুজামুল কাবির

২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION