শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

উদাসীনতার কুফল থেকে বাঁচতে করণীয়

শায়খ আহমাদ বিন তালেব বিন হামিদ:
মুমিন-মুসলমানদের করণীয় হলো, অন্তর সংশোধনকারী আমল দ্বারা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা এবং সম্ভাব্য বিনষ্টকারী বিষয় থেকে এটাকে সংরক্ষণে রাখা; কেননা অন্তর হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিয়ন্ত্রক। এ মর্মে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত নোমান বিন বাশির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে, সেটি যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর সেটি যখন খারাপ হয়ে যায় গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, ওই মাংসপিণ্ডটি হলো কলব তথা অন্তর।’ (সহিহ বোখারি)।

আপনারা কি জানেন, অন্তরের সবচেয়ে বড় ব্যাধি সম্পর্কে? যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়? অথবা তাতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কল্যাণের অসংখ্য দ্বার থেকে বঞ্চিত করা হয়?

অন্তরের সবচেয়ে বড় ব্যাধিগুলোর অন্যতম হলো গাফিলতি। চরম গাফিলতির কারণে কাফের ও মুনাফেকরা হতভাগ্য হয়েছে এবং এটা তাদের জাহান্নামে স্থায়ী হওয়াকে অবধারিত করেছে। একজন মুসলমানের পক্ষে কল্যাণকর কোনো কাজে, উপকরণ গ্রহণে ও অকল্যাণ হতে নাজাতের পথ অবলম্বনে গাফিলতি হতে পারে। ফলে তার গাফিলতির পরিমাণ অনুসারে কল্যাণমূলক কাজের সওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়। নাজাতের অবলম্বন পরিত্যাগের কারণে তার গাফিলতির পরিমাণ অনুসারে দুর্ভাগ্য ও মন্দ দ্বারা তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর প্রত্যেকের জন্য তাদের আমল অনুসারে মর্যাদা রয়েছে এবং যাতে আল্লাহ প্রত্যেকের কাজের পূর্ণ প্রতিফল দিতে পারেন। আর তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা আল আহকাফ : ১৯)।

গাফিলতির অর্থ হলো ইচ্ছাকৃতভাবে কল্যাণ কামনা না করা ও তা পছন্দ না করা, সেই সঙ্গে উপকারী জ্ঞান ও সৎকর্ম থেকে অন্তরশূন্য হওয়া। এটাই হলো ধ্বংসকারী চরম গাফিলতি। যখন উদাসীনতা কোনো ব্যক্তির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন সে শুধু ধারণা ও মনোবৃত্তির অনুসরণ এবং এটাকে শয়তান তার কাছে সুশোভিত করে তোলে। তার চিত্ত নানান কুপ্রবৃত্তিকে ভালোবাসে। এ জাতীয় গাফিলতির কারণে আল্লাহতায়ালা কাফের এবং মুনাফিকদের দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি প্রদান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি; তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে তা দ্বারা তারা শোনে না; তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত। তারাই হচ্ছে গাফেল।’ (সুরা আল আরাফ : ১৭৯)।

কাফের ও মুনাফিকদের গাফিলতি হলো চরম গাফিলতি, যা তার অধিকারীকে জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা করে দেয়। তা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে কল্যাণ কামনা না করা, উপকারী জ্ঞান ও সৎকর্ম থেকে অন্তরশূন্য হওয়া এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা।

অন্যপক্ষে মুসলিম ব্যক্তির গাফিলতি হলো, এমন কিছু সৎকর্ম থেকে উদাসীন হওয়া, যা ত্যাগ করলে ইসলামের বিরুদ্ধে চলে যায় না। অথবা কুফরি নয় এমন গোনাহে লিপ্ত হওয়া এবং তার শাস্তি সম্বন্ধে উদাসীন থাকা। মুসলিম ব্যক্তির গাফিলতিও তার জন্য গুরুতর মন্দ ও ভয়াবহ ক্ষতির কারণ, যা তার জন্য ধ্বংস ডেকে আনে এবং কল্যাণের পথগুলো রুদ্ধ করে দেয়।

গাফিলতির অসংখ্য ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। পরিপূর্ণ তাওহিদের জ্ঞান সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে একজন মুসলিম পূর্ণ তাওহিদের বিষয়ে ত্রুটি করে। নামাজের রোকন ও ওয়াজিবগুলো জানার ব্যাপারে উদাসীনতার কারণে নামাজে ত্রুটি ঘটে। জামাতের সঙ্গে নামাজে শরিক থেকে উদাসীনতা ব্যক্তিকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে শিথিলতার দিকে নিয়ে যায়। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকদের কাছে সবচেয়ে কষ্টকর নামাজ হলো এশা এবং ফজরের নামাজ। যদি তারা জানত এ দুটি নামাজে কী মর্যাদা রয়েছে, তাহলে অবশ্যই তারা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও উপস্থিত হতো।’ (সহিহ বোখারি)।

জাকাতের প্রতিদান সম্পর্কে উদাসীনতা এবং জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতির শাস্তি সম্পর্কে গাফিলতির দরুন তা আদায়ে অবহেলার সৃষ্টি হয়। অথচ হাদিসে রয়েছে, ‘বিত্তশালী যে ব্যক্তি তার সম্পদের জাকাত আদায় করবে না, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করা হবে। সাপটি তার মুখের দুই পাশ কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ, আমি তোমার মাল।’ (সহিহ বোখারি)।

মাতা-পিতার অবাধ্যচারণের শাস্তি সম্পর্কে গাফিলতির কারণে সন্তান অবাধ্যচরণে লিপ্ত হয়; ফলে তার ওপর রাসুল (সা.)-এর বাণী অবধারিত হয়, ‘তিন শ্রেণির ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না; মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, দাইয়ুস এবং পুরুষের বেশধারিণী নারী।’ (সুনানে নাসায়ি)

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর ওপর শাস্তি পতিত হয়। জুবাইর বিন মুতয়িম (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ বোখারি)।

জুলুমের শাস্তি সম্বন্ধে গাফিলতির কারণে জমিনে জুলুম বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তপাত ঘটে, অন্যের সম্পদ ছিনতাই করা হয়, সম্ভ্রমহানি ঘটে, বসতি বিরান হয়, জমিন জনশূন্য হয়, শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংস করা হয় এবং সর্বত্র ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর জালিমের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ হয়।

গাফিলতি সব অনিষ্টের মূল এবং এ কারণে একজন মুসলিম প্রভূত প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হয়। মুসলিম ব্যক্তির মাঝে ত্রুটি-বিচ্যুতি উদাসীনতার দ্বার দিয়েই প্রবেশ করে। কাজেই তা থেকে নাজাতই হলো পরম সৌভাগ্য, তা থেকে দূরে থাকার অর্থ হলো ইবাদতের স্তরে উন্নতি এবং তা থেকে সতর্ক থাকা হলো দুনিয়াতে শাস্তি থেকে রক্ষাকবচ গ্রহণ ও মৃত্যুর পরে চিরস্থায়ী নেয়ামত অর্জন।

গাফিলতি হতে মুক্তি ও বাঁচার উপায় হলো, তার উপকরণ হতে বিরত থাকা, দুনিয়ার প্রতি পরিপূর্ণ ঝুঁকে না পড়া; যা ব্যক্তিকে আখিরাত বিমুখ করে দেয়। গাফিলতি এড়িয়ে চলতে মুমিনের অন্যতম সহায়ক হলো আল্লাহর ভয় ও একাগ্রতার সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করা। কেননা নামাজ হৃদয়ের জীবনকে প্রাণবন্ত করে, কারণ এতে বিদ্যমান আছে মহান তাৎপর্য।

গাফিলতি থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপায় হলো সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করা। কেননা জিকির অন্তরকে জীবিত রাখে, শয়তানকে বিতাড়িত করে, আত্মাকে পবিত্র রাখে, ইবাদত পালনে শরীরকে শক্তিশালী করে, ভ্রমের নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে এবং নিয়মিত জিকির বান্দাকে পাপের কাজ থেকে রক্ষা করে।

গাফিলতি থেকে বান্দাকে রক্ষা করতে পারে কোরআন তেলাওয়াত, কেননা এতে রয়েছে অনেক বিস্ময়কর ও আকর্ষণীয় বস্তু, আছে অন্তরের আরোগ্য, ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান এবং মন্দ কাজ হতে বারণ।

গাফিলতি থেকে বাঁচার আরেকটি মাধ্যম হলো, আলেম ও সৎ লোকের সাহচর্য। কেননা তারা আল্লাহর বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেন এবং শরিয়তের ইলম শিক্ষা দেন। এ ছাড়া অবান্তর ও অনৈতিক বৈঠকে অংশগ্রহণ এবং খারাপ বন্ধুর সংস্রব হতে বিরত থাকা। দুনিয়ার তুচ্ছতা ও বিলুপ্তির কথা স্মরণে রাখা এবং দুনিয়ার সৌন্দর্য ও চাকচিক্যে আখিরাত বিমুখ না হওয়া। কেননা তা অধিকাংশ মানুষকে আখিরাত ও সঠিক পথ অনুসরণ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে।

গোনাহ ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকা, কেননা গাফিলতির কারণেই বান্দা সব ধরনের পাপে পতিত হয়ে থাকে। একজন মুসলিমকে গাফিলতি এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মৃত্যু ও তৎপরবর্তী অবস্থার স্মরণ। কেননা এটা উত্তম উপদেশদাতার ন্যায়, এটা এমন যা প্রত্যক্ষ ও শ্রুত, যার স্বাদ-আস্বাদন সুনিশ্চিত, সাক্ষাৎ লাভ নিকটবর্তী এবং যা অবশ্যম্ভাবী। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জীবনের স্বাদ হরণকারী বিষয়কে অর্থাৎ মৃত্যুকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (সুনানে তিরমিজি)

যে ব্যক্তি বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে, তার অন্তর পরিশুদ্ধ হবে, আমল হবে পবিত্র এবং সে গাফিলতি থেকে মুক্ত হবে। মৃত্যুর সময় মুমিন ব্যক্তি আনন্দিত হয় আর ফাসেক অনুশোচনা করে ও পুনরায় ফিরে আসতে চায়, তবে তার প্রত্যাশা কবুল হওয়া অসম্ভব। আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন তাদের কারও মৃত্যু আসে, সে বলে, হে আমার রব! আমাকে আবার ফেরত পাঠান। যাতে আমি সৎকাজ করতে পারি যা আমি আগে করিনি। না, এটা হওয়ার নয়। এটা তো তার একটি বাক্যমাত্র যা সে বলবেই। তাদের সামনে বারজাখ থাকবে উত্থান দিন পর্যন্ত।’ (সুরা আল-মুমিনুন : ৯৯-১০০)।

১২ জানুয়ারি শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION