শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২২ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বসন্ত আনে নবযৌবন প্রাণে

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
বসন্ত মানে প্রাকৃতিক প্রাণের গুঞ্জরণ। শীতার্ত সময় পেরিয়ে অঙ্কুরিত ফুল পাতায় বসন্ত দিয়ে যায় প্রেম ও বিদ্রোহের বার্তা। লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র

ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব সব জাতির মধ্যেই দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা একে আদি প্রবৃত্তি বলে চিহ্নিত করেন। যে কারণে প্রযুক্তিনির্ভর নাগরিক জীবনেও দেখা যায় প্রকৃতিঘনিষ্ঠ উৎসব পালিত হচ্ছে। বাঙালির জীবনে যেমন বসন্ত। তবে এ বসন্ত উৎসব অন্যান্য ঋতুর তুলনায় বর্ণিল ও বহুমুখী। কারণ এ ঋতুতে প্রেম ও বিদ্রোহের যুগলবন্দি ঘটে।

বসন্তের শুরু ফাল্গুন দিয়ে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ফাগুন বা ফাল্গুন বাংলা সনের এগারতম মাস। এটি নেপালি বর্ষপঞ্জিরও এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বাদশ এবং সমাপনী মাস। যা বাংলাদেশ, নেপাল এবং আসামের ষষ্ঠ ও অন্তিম ঋতু। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ফাল্গুন মাস সাধারণত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়। বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে সরকারিভাবে ফাল্গুন মাস ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়।

পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতে ঋতুকে কেন্দ্র করে উৎসব হয়। বিশেষ করে শিকারের সময়ের শুরু, ফসল তোলা, গ্রীষ্ম বা শীতের শুরু অথবা শেষ, ফসল বোনার সময়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত এসব উৎসব। গবেষকরা বলছেন, ঋতুর সংখ্যা ও

প্রকৃতি এবং তাদের প্রভাব বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। সময়ের সঙ্গে উৎসব ও ঋতুর চরিত্রও পরিবর্তিত হয়। প্যালিওলিথিক শিকারি সমাজ থেকে নিওলিথিক কৃষি তারপর আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে ঋতু ও উৎসবের ভিন্নতা দেখা গেছে।

ধারণা করা হয়, বাংলায় এ উৎসব আসে ভারতের পুরীতে ফাল্গুন মাসে আয়োজিত দোল উৎসব থেকে। যদিও তার আগে মধ্যযুগ থেকে বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলায় রাসমেলা বা রাসযাত্রার প্রচলন ছিল। নবদ্বীপ থেকে রাসমেলার উৎপত্তি বলে ইতিহাসে জানা যায়। বসন্তকালে বাংলাদেশের খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাসমেলা হয়ে থাকে। সেখানে কীর্তন গান ও নাচের আসর বসে। এ ছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ফাল্গুনী পূর্ণিমা উদযাপনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিত বলে জানা যায়।

১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। একই সঙ্গে প্রবর্তিত হয় প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও। এর মধ্যেই অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব।

জানা যায়, আধুনিককালে শান্তিনিকেতনে ১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেন ঋতুরঙ্গ উৎসব। সেদিন শান্তিনিকেতনের প্রাণ কুটিরের সামনে শুরু হয় এ উৎসব। সেই ঋতুরঙ্গ উৎসব পরে হয় বসন্ত উৎসব। আগে বসন্তের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হতো এ উৎসব। পরে বসন্ত পূর্ণিমার দিনই অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বসন্তপ্রেমী। বিভিন্ন ঋতু নিয়েই তাদের গান আছে। বর্ষার পর রবীন্দ্রনাথ বসন্ত নিয়ে বেশি গান লিখেছেন। আর নজরুল নিজেই যেন ছিলেন এক বসন্ত। রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন নজরুলকে। জানা যায়, ১৯২৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতার ‘অ্যালফ্রেড থিয়েটার’-এ ‘বসন্ত’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় বসন্ত উৎসব। ওইদিন সকালে নজরুল-ঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে ‘বসন্ত’র দুটি কপি দিয়ে নজরুলকে তা দিয়ে আসতে বলেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল তখন তরুণ। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ব্রিটিশিবিরোধী কবিতা লেখার জন্য ১৯২২ সালের নভেম্বরে নজরুলকে কারারুদ্ধ করা হয়। তখন নজরুল ছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় সেখানে গিয়ে তাকে বইয়ের একটি কপি দেন। বই বুকে নিয়ে আনন্দে তখন নেচে ওঠেন নজরুল। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা জেল-সুপার এসব দেখে, পবিত্রবাবুর কাছে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী? পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বললেন যে, ‘পোয়েট টেগোর’ নজরুলকে এই বইটি ‘ডেডিকেট’ করেছেন। সুপার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউ মিন প্রেজেন্টেড?’ পবিত্রবাবু বলেন, ‘নো ডেডিকেটেড’।

পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তখন আরও জানান, বই দুটি রবীন্দ্রনাথ তাকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘…তাকে (নজরুল) বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো কবিতা লেখা যেন কোনো কারণে সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই’। কেউ কেউ দাবি করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন নজরুলক বসন্ত বলে অভিহিত করেছিলেন।

বিরহের ঋতু

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বসন্ত আমাদের মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। বসন্তে আমাদের মন অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যায়, বাতাসের উপর ভাসিতে থাকে, ফুলের গন্ধে মাতাল হইয়া জ্যোৎস্নার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ে; আমাদের মন বাতাসের মতো, ফুলের গন্ধের মতো, জ্যোৎস্নার মতো, লঘু হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। বসন্তে বহির্জগৎ গৃহদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া আমাদের মনকে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়া যায়। বসন্ত ও বর্ষা প্রবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘বসন্তকালে আমরা বহির্জগৎ উপভোগ করি; উপভোগের সমস্ত উপাদান আছে, কেবল একটি পাইতেছি না; উপভোগের একটা মহাঅসম্পূর্ণতা দেখিতেছি। সেই জন্যই আর কিছুই ভালো লাগিতেছে না। এত দিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল, আমার প্রিয়তম ছিল না; আমার আর কোনো সুখের উপকরণও ছিল না। কিন্তু জ্যোৎস্না, বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া তুলিল; সে জাগিয়া দেখিল তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই বসন্তের বিরহ। দুর্ভিক্ষের সময় শিশু মরিয়া গেলেও মায়ের মন অনেকটা শান্তি পায়, কিন্তু সে বাঁচিয়া থাকিয়া ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদিতে

থাকিলে তাঁহার কি কষ্ট!’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘‘বর্ষাকালে বিরহিণীর সমস্ত ‘আমি’ একত্র হয়, সমস্ত ‘আমি’ জাগিয়া উঠে; দেখে যে বিচ্ছিন্ন ‘আমি’, একক ‘আমি’ অসম্পূর্ণ। সে কাঁদিতে থাকে। সে তাহার নিজের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করিবার জন্য কাহাকেও খুঁজিয়া পায় না। চারি দিকে বৃষ্টি পড়িতেছে, অন্ধকার করিয়াছে; কাহাকেও পাইবার নাই, কিছুই দেখিবার নাই; কেবল বসিয়া বসিয়া অন্তর্দেশের অন্ধকারবাসী একটি অসম্পূর্ণ, সঙ্গীহীন ‘আমি’র পানে চাহিয়া কাঁদিতে থাকে। ইহাই বর্ষাকালের বিরহ। বসন্তকালে বিরহিণীর জগৎ অসম্পূর্ণ, বর্ষাকালে বিরহিণীর ‘স্বয়ং’ অসম্পূর্ণ। বর্ষাকালে আমি আত্মা চাই, বসন্তকাল আমি সুখ চাই। সুতরাং বর্ষাকালের বিরহ গুরুতর। এ বিরহে যৌবন মদন প্রভৃতি কিছু নাই, ইহা বস্তুগত নহে। মদনের শর বসন্তের ফুল দিয়া গঠিত, বর্ষার বৃষ্টিধারা দিয়া নহে। বসন্তকালে আমরা নিজের উপর সমস্ত জগৎ স্থাপিত করিতে চাহি, বর্ষাকালে সমস্ত জগতের মধ্যে সম্পূর্ণ আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি।’’

বিদ্রোহ ও প্রেম

বাংলাদেশের জীবনে বসন্ত বিদ্রোহের ঋতু। কারণ ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল তরুণরা। সেদিন বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেন সালাম-বরকত-শফিক-জব্বার। পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করত। নানা বিধিনিষেধ আরোপ করত। যার কারণে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রকাশও বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। যে কারণে দেখা যায় ষাটের দশক থেকে বাঙালি নারীরা পয়লা ফাল্গুনে হলুদ শাড়ি পরছে। তারা গলায়-কানে ফুল পরে বের হচ্ছে।

পরে ১৯৮৩ সালের আরেক বসন্তদিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের প্রতিবাদে মিছিল বের হয়। সেদিন স্বৈরাচার আর স্বৈরশাসনের সাম্প্রদায়িক, গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালী, আইয়ুব, ফারুকসহ নাম না জানা আরও অনেক মানুষ। তাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ।

আবার এ বসন্তে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ভালোবাসা দিবস। যা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেবদেবীর রানী জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবি বলা হতো। তার সম্মানে এই ভালোবাসা দিবস। আবার কেউ কেউ মনে করেন ২০০ খ্রিস্টাব্দে রোমে ভালোবাসার জন্য প্রাণ দেন ভ্যালেন্টাইন। প্রেমের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ওই তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। যার কারণে দিবসটির নাম হয় ভ্যালেন্টাইন ডে।

কেন হলুদ

বসন্তে হলুদ রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে শুধু বাংলায় নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হলুদ বসন্তের রঙ হিসেবে উদযাপিত হয়। এর কারণ হলো এ সময়ে প্রকৃতিতে প্রচুর হলুদ ফুল ফোটে। আমাদের জন্য যেমন সরষে বা গাঁদা ফুল পরিচিত। এ ছাড়া হলুদ রুদ্র পলাশ, কনকচাঁপা ফুলও রয়েছে। অন্যান্য দেশেও এ রঙের ফুলের প্রাধান্য থাকে। তাই হলুদ বসন্তের রঙ। এর সঙ্গে থাকে সবুজ। এ সময়ে কোথাও কোথাও কৃষ্ণচূড়া, সোনালুও ফুটে থাকে। বাংলায় এমন বিশ্বাসও আছে যে, হলুদ সূর্যের রঙ এবং সূর্যের রশ্মি যেমন অন্ধকারকে ধ্বংস করে, তেমনি মানুষের অন্তরের অশুভ অনুভূতিকে ধ্বংস করে।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION