রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন: যৌক্তিকতা ও উচ্চশিক্ষার সুরক্ষার দায়িত্বশীলতা

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন:

অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৩ মার্চ ২০২৪ এ জারিকৃত ‘প্রত্যয়’ নামে পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তিকরণ ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাত্মক ক‍‍র্মবিরতি পালন করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ আন্দোলন চললেও এতদিন পর্যন্ত এ আন্দোলন ছিল অত্যন্ত ‘সফট’ প্রকৃতির; কেননা সেখানে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি কিংবা অর্ধ-দিবস ক‍‍র্মবিরতি পালন করা হয় কিন্তু পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল কা‍র্যক্রম ক‍‍র্মসূচির আওতামুক্ত রাখা হয়। এটাই শিক্ষকসুলভ আচরণ ও শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা। কেননা নিজের মান-মর্যাদা রক্ষা, সুযোগ-সুবিধা সুরক্ষা ও দাবি-দাওয়ার আন্দোলন অনিবার্য হয়ে পড়ার পরও শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমের যেন কোনও ক্ষতি না-হয় সেটাকে প্রাধান্য দিয়েই কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু একটি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবিতে শিক্ষকদের এই দায়িত্বশীল কর্মসূচি-ভিত্তিক আন্দোলনকে কেউ কোনও যেন পাত্তাই দিল না! ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের নির্বাচিত শিক্ষক সমিতিগুলোর জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে নানান আবেদন, নিবেদন ও আহাজারি করলেও কোনও জায়গা থেকে কোনও কর্তৃপক্ষ কোনও ধরনের কর্ণপাত করেনি। ফলে সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষকরা ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকদেরেক কারা একটি স‍‍র্বাত্মক ক‍‍র্মবিরতির মতো ক‍‍র্মসূচির দিকে ঠেলে দিল? কোন স্বা‍র্থান্বেষী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্থির করার অপচেষ্টা করছে? কোন বিশেষ মহল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে রাস্তায় নামিয়ে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানো অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে? এসব গভীরভাবে ভেবে দেখা জরুরি। এখানে লেখাবাহুল্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবসময় আস্থাশীল এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহীর কারণে মাঝে মাঝে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিম নিয়ে বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় বিস্তর লেখালেখি ও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ এটার পক্ষে এবং বিপক্ষে বুঝে বা না-বুঝে মতামত দিচ্ছেন কিন্তু একবারও কেউ চিন্তা করেছেন না যে, যেসব শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন সেসব শিক্ষকরা এ ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমের মধ্যে পড়েন না। এ স্কিমে পড়বেন তারা, যারা ১ জুলাই, ২০২৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যোগদান করবেন। তাহলে যারা এই প্রত্যয় স্কিমের কারণে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, তারা কেন এ স্কিমের বাতিলের জন্য আন্দোলন করছেন? আমরা কি একবারও সেটা ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি?

এটাই মূল পয়েন্ট যেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন নিজের ব্যক্তিগত আর্থিক হিসাব-নিকাশ, সুবিধা-অসুবিধা এবং নিজের পেনশন পাওয়া বা না-পাওয়া দুঃশ্চিন্তা নিয়ে নয়। বরঞ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অনাগত শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নি‍র্মাণ করবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিক্ষককের এ আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এ আন্দোলন ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠার জন্য, এ আন্দোলন শিক্ষকদের মান-মর্যাদা সুরক্ষার জন্য এবং সংবিধানে যে সমতা বিধানের বাধ্যবাধ্যতা রয়েছে শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন সমাজে সে সুযোগের সমতা বিধানের মৌলিক প্রশ্নে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের এই আন্দোলন বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দায়িত্বশীলতা থেকে। এই সত্যটুকু আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে উচ্চশিক্ষার মান, মর্যাদা, এবং ভবিষ্যতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না-পারলে মানুষ হিসেবে, সমাজ হিসেবে এবং রাষ্ট্র হিসেবে আমরা খুব বেশি দূর আগাতে পারব না।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজকে সময়ের দাবিতে দেশের উচ্চশিক্ষা ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দায় ও দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এটাই শিক্ষকদের আন্দোলনের মূল দ‍‍র্শন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে আমি এ দ‍‍র্শন থেকে এ আন্দোলনকে সম‍‍র্থন করি; এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।

আমি অত্যন্ত সংক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা, ন্যায্যতা এবং এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা নিম্ন উপস্থাপন করছি। ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩’ অনুযায়ী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ আগস্ট ২০২৩ তারিখে এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এক নতুন যুগান্তরকারী অধ্যায় সূচনা করেছে। আমরা এ ক‍‍র্মসূচিকে স্বাগত জানাই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ৪টি প্যাকেজ বা স্কিম চালু করে। প্যাকেজসমূহ হলো- প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা। এই চারটি স্কিম পর্যালোচনা করলে স্পষ্টই বুঝা যায়, সকল নাগরিক যাদের বয়স ১৮ বা তদুর্ধ্ব কিন্তু ৬০ বছরের নিচে তারা সবাই যেন অন্তর্ভুক্তি হতে পারে তা ব্যবস্থাকরণ।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বা অনুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত তাদের জন্য সরকার ‘প্রগতি স্কিম’ চালু করেছে। আবার অনানুষ্ঠানিক বা স্বকার্যে নিয়োজিতদের জন্য ‘সুরক্ষা স্কিম’ চালু রয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের ব্যক্তিগণের জন্য রয়েছে ‘সমতা’। উল্লেখ্য সমতা স্কিমের জন্য নির্ধারিত চাঁদার পরিমাণ ৫০০ টাকা যার সমপরিমাণ সরকার প্রদান করবে। এ সা‍র্বজনীন পেনশন স্কিম ঘোষণা করার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “যারা সরকারি চাকরিজীবী তারা তো পান পেনশন। কাজেই এটা সরকারি চাকরীজীবীদের জন্য না। যারা সরকারি বেতন পাবেন, সরকারি পেনশন পাবেন, তাদের জন্য এটা প্রযোজ্য হবে না। এর বাইরে যে জনগোষ্ঠী, শুধুমাত্র তাদের জন্য এ ব্যবস্থাটা আমরা করে দিচ্ছি। যাতে করে তারাও একটু সম্মানজনকভাবে বাচঁতে পারে।”

সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিদ্যমান অবস্থায় একটা চমৎকার পেনশন ব্যবস্থার মধ্যে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সা‍র্বজনীন পেনশন স্কিমে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থাকার কথা নয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অ‍‍র্থমন্ত্রণায় ১৩ র্মাচ ২০২৪ তারিখে জারিকৃত এস.আর.ও. নং ৪৭-আইন/২০২৪ এর মাধ্যমে সকল স্ব-শাসতি, স্বায়ত্তশাসতি, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবধিবিদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয় স্কিম’ ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে সর্বজনীন পেনশনে অর্ন্তভুক্তি করে নেয়।

আমরা অত্যন্ত দুঃখ এবং পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করলাম যে এ ‘প্রত্যয় স্কিম’ অত্যন্ত বৈষম্যপূ‍র্ণ, অন্যায্য, অন্যায়, অসমতা সৃষ্টিকারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন বিরোধী এবং সংবিধানের সমতা বিধানের দ‍‍র্শনের সাথে সাংঘ‍‍র্ষিক। আমি সংক্ষেপে পয়েন্ট-বাই-পয়েন্ট কয়েকটি মৌলিক বিবেচ্য-বিষয় এখানে তুলে ধরছি। উল্লেখ্য যে, নিম্নোক্ত তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কর্তৃক গঠিত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি প্রদ‍ত্ত চার পৃষ্ঠার রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছি বিধায় ক‍‍র্জ স্বীকার করছি। এ তুলনামূলক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা উন্মোচিত হয়। যেমন:

১. বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশন বাবদ কোনো অর্থ কর্তন করা হয় না। ‘প্রত্যয়’ স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫০০০ টাকা (যেটি সর্বনিম্ন) হারে টাকা কর্তন করা হবে। একজন ছাত্র পাস করার পর ৩০ বছরেও যদি শিক্ষকতায় যোগদান করে তার চাকরিকাল দাঁড়ায় ৩৫ বছর। ধরে নিলাম সে মাসিক ৫০০০ টাকা মূল বেতন হতে কর্তন করে বাকি ৩৫ বছরের জন্য। সে হিসাবে মোট কর্তনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ লক্ষ টাকা। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় মোট কর্তনের পরিমাণ শূন্য। অদ্ভুত বৈষম্য।

২. বর্তমানে একজন অধ্যাপক (৭৮,০০০ টাকা বেতন স্কেলে) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন গ্রাচুইটি বা আনুতোষিক পান ৮০,৭৩,০০০/-টাকা। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় বা প্রত্যয় স্কিমে এককালীন আনুতোষিকের পরিমাণ শূন্য। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

৩. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক যদি ১০ শতাংশ হারে পেনশন ফান্ডে অথবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তাহলে মাসিক পেনশন দাঁড়ায় ১,১৩,০৬৫/- টাকা (৬৭,২৭৫+৪৫,৭৯০)। অর্থাৎ, বিদ্যমান প্রচলিত সুবিধা অর্ধেক করা হয়েছে প্রত্যয় স্কিমে।

৪. বিদ্যমান পেনশনে অর্জিত ছুটি (স‍‍র্বোচ্চ ১৮ মাস) অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। অতএব বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সাথে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করছে বলে প্রতীয়মান হয়।

৫. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হন। কিন্তু, প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার যদিও আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হবেন। কিন্তু, পেনশনারের যদি কোনও কারণে মৃত্যু হয় তবে নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ বৎসর পূর্তি পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আবার নমিনিও যদি পেনশনার হন তাহলে উনি কি ডাবল বিনিফিট পাবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। এটাও নতুন ঝুঁকির সৃষ্টি করে।

৬. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বর্তমানে একজন অধ্যাপক কমপক্ষে ১,১৩,০৬৫/- টাকার মাসিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ভবিষ্যতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে তা বর্তমান পেনশন গ্রহীতার তুলনায় অতি নগন্য। যে কারণে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

৭. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন এল.পি.আর. সুবিধা প্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোনও দিক নির্দেশনা নেই। এল.পি.আরের অর্থ বিবেচনায় নিলে বিদ্যমান পেনশন স্কিম হতে প্রাপ্ত সুবিধা প্রত্যয় স্কিমের তুলনায় আরও অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়।

৮. নতুন প্রত্যয় স্কিমে অবসরকালীন সময়ে চিকিৎসা ভাতার কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যেখানে সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সেখানে চিকিৎসা ভাতার কোনও উল্লেখ না-থাকা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জীবনকে শেষ বয়সের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে যা একেবারেই কাম্য নয়।

৯. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় নিট পেনশনের ওপর ৫ শতাংশ হারে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট শূন্য। পেনশনারের ক্রয় ক্ষমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্যাকেজসমূহ তৈরি কোনোভাবেই বাস্তবিক নয় এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন স্কিমের সাথে প্রত্যয় স্কিম সাংঘর্ষিক।

১০. বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ বছর। প্রত্যয় স্কিমে অবসরকালীন বয়স স্থির ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বয়সসীমা কত হবে বা প্রত্যয় স্কিমে কীভাবে সামঞ্জস্য আনা হবে এ ব্যাপারে কোনও দিক নির্দেশনা নেই। এতে প্রতীয়মান হয় যে, বিশদ বিশ্লেষণ এবং প‍‍র্যাপ্ত হোমওয়া‍র্ক ছাড়া প্রত্যয় স্কিম চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিংবা অত্যন্ত সুকৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের সময়সীমা কমিয়ে ৬৫ এর স্থলে ৬০ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

১১. বিদ্যমান পেনশন স্কিমে মাসিক পেনশনের সাথে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, বছরে দু’টি উৎসব ভাতা ও ১টি বৈশাখী ভাতা প্রদান করা হয় যা অর্থমূল্যে অনেক। কিন্তু প্রত্যয় স্কিম প্রকল্পে এসব বাদ দেওয়া হয়েছে। অ‍‍র্থাৎ আপনি অবসরে যাওয়ার পর আপনার আর ঈদ, কুরবানী, বা পুজা, পা‍র্বন বা বাংলা নবব‍‍র্ষ প্রভৃতি কোনও উৎসবের দরকার নেই। এটা অত্যন্ত অমানবিক।

১২. এই ব্যবস্থা সরকারি অন্যান্য চাকরিজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যে তৈরি করবে, যা সংবিধানের সমতার নীতির পরিপন্থী।

এ যখন প্রত্যয় স্কিমের অবস্থা, তখন অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই তরুণ আগামী দিনের মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসার আগ্রহ হারাবে। ফলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পিছিয়ে পড়বে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পরিসর সংকুচিত হবে। তাই, উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে সংকটাপন্ন। জাতি ও সমাজ দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে “উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত” করার স্বপ্ন, প্রকল্প ও পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে। আর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ব্যানারে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ সংকট থেকে দেশকে ও জাতি বাঁচানোর জন্যই এ আন্দোলন করছেন।

আমাদের অজানা নয় যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তাই জাতির মেরুদণ্ডকে শক্ত, মজবুত ও টেকসই রাখতে শিক্ষার ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য প্রত্যয় স্কিম অতিদ্রুত প্রত্যাহার করা জরুরি।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ভয়েস/আআ/সূত্র: বাংলাট্রিবিউন।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION