বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নবীজির জীবনী চর্চা জোরদার করতে হবে

মুফতি মাহবুব হাসান:
হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তিনি ছিলেন বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত। তার জন্ম ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল। যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন। তিনি অবশ্যই একজন মহামানব। তার জন্মের আগে মক্কায় মহা দুর্ভিক্ষ চলছিল। তিনি তার মায়ের গর্ভে এলে দুর্ভিক্ষ অবসান হয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া জমজম কূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তার মা বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ (সা.) তার পেটে অবস্থান নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল, যার সাহায্যে তিনি সুদূর সিরিয়ার রাজ প্রাসাদগুলো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। এমনিভাবে আরও অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটছিল। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, মক্কায় তখন ভূ-কম্পনের দ্বারা মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। পারস্য সম্রাটের রাজমহলে ভূ-কম্পনের আঘাতে রাজমহলের ১৪টি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। একদিকে শান্তির আগমন অন্যদিকে বাতিলের মাথায় আঘাত পড়েছিল।

মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের ছয় মাস আগেই তার পিতা আবদুল্লাহ সফররত অবস্থায় মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার মাতা আমেনা মদিনা মুনাওয়ারায় নিজ স্বামী আবদুল্লাহর কবর জিয়ারতের পর ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝে অবস্থিত আবহাওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তখন মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মুত্তালিব তার লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি তাকে খুব স্নেহ করতেন। এমনকি নিজের ছেলেদের ওপরও তাকে প্রাধান্য দিতেন। দাদার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তার দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল আট বছর।

মক্কার মানুষের কাছে তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার আচার-ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হতেন। ছোট বেলায় তিনি বকরি পালন করেছেন। একটু বড় হওয়ার পর জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে মক্কার বাইরে যেতেন। খাদিজা (রা.)-ও তাকে ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রির জন্য মক্কার বাইরে পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর যখন তার বয়স ২৫ বছর হয়, তখন খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ করেন। একমাত্র ইব্রাহিম ব্যতীত তার সব কয়টি সন্তান খাদিজার (রা.)-এর গর্ভ থেকেই হয়েছে। কাসেম তার প্রথম সন্তান। কাসেমের নামেই তার উপনাম আবুল কাসেম। অতঃপর জয়নব, ররুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও আবদুল্লাহ (রা.)-এর জন্ম হয়। তার ছেলের সবাই বাল্য বয়সে মারা যান। মেয়েদের সবাই ইসলাম গ্রহণ করে হিজরত করার সুযোগ পান। ফাতেমা (রা.) ব্যতীত তাদের সবাই নবীজির জীবদ্দশায় মারা যান। তিনি নবীজির ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করেন।

৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। জিবরাইল (আ.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি নিয়ে অবতরণ করেন। রাসুল (সা.) স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ যথাযথ পালন করেন এবং গোপনে গোপনে মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। যাতে করে কুরাইশদের বিরোধিতা প্রকট না হয়। তিনি সর্বপ্রথম আপন পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবর্গকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম খাদিজা (রা.) তার দাওয়াত গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বকর (রা.), ছোটদের মধ্যে আলী (রা.) এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.) তিন বছর পর্যন্ত তার নিকটস্থ লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন।

যখন ক্রমে ক্রমে ইসলাম প্রচারের বিষয়টি প্রকাশ পেতে থাকে, তখন মুশরিকরা রাসুল (সা.)-কে বিভিন্ন উপায়ে উপহাস করতে শুরু করে। কখনো কখনো তাকে পাগল ও জাদুকর বলত। আবার কখনো বলত কবি ও গণক। আগন্তুক লোকদের তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা শুনতে বাধা দিত। তার চলাচলের রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখত এবং নামাজরত অবস্থায় তার ওপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত। এভাবে মুশরিকদের সব নিপীড়ন তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতেন।

মুশরিকদের অনবরত নির্যাতনের কারণে রাসুল (সা.) সাহাবিদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে হাবশাতে হিজরত করার নির্দেশ দেন। হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ছিলেন বলে হাবশাকেই হিজরতের জন্য মনোনীত করেন। নাজ্জাশী ঈসা (আ.)-এর অনুসারী ছিলেন। নবুওয়াতের ৫০ বছর মুহাজিরদের প্রথম এ দলে ছিলেন ১০ পুরুষ ও চার নারী। তারা কুরাইশদের অজান্তে চুপিসারে হাবশার উদ্দেশে রওনা হন। কিছুদিন পর আরও একটি মুহাজির দল তাদের সঙ্গে মিলিত হন। পুরুষ, নারী, শিশুসহ তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন। বাদশা নাজ্জাশী তাদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার এবং অত্যন্ত সম্মান করেন। পাশাপাশি সেখানে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ করে দেন।

এমন মুহূর্তে রাসুল (সা.)-এর আশ্রয়দাতা চাচা আবু তালিব মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা ও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করেন। কিন্তু সেখানে উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পাননি। তারা রাসুল (সা.)-কে পাথর নিক্ষেপ করে গুরুতর আহত করে। বাধ্য হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। এরই মধ্যে তার স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন।

কুরাইশরা রাসুল (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। মহান আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় পৌঁছার পর ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয়। ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মুসলমানরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা মহান আল্লাহর নির্দেশে মুশরিকদের বিরুদ্ধে একাধিকবার যুদ্ধ করেন। এতে মুসলমানরা বিজয়ী আর মুশরিকরা পরাজিত হতে থাকে। ফলে মুশরিকরা ক্রমশই দুর্বল হয়ে যায়।

মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের চুক্তি হয়। কিছুদিন পর কুরাইশরা চুক্তি ভঙ্গ করে। তখন ছিল হিজরি অষ্টম বর্ষের রমজান মাস। রাসুল (সা.) ১০ হাজার যোদ্ধা নিয়ে মক্কা বিজয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন। এদিকে কুরাইশরা মুসলমানদের মক্কাভিমুখে অভিযানের সংবাদ পেয়ে তাদের নেতা ও মুখপাত্র আবু সুফিয়ানকে ক্ষমা প্রার্থনা, সন্ধিচুক্তি বলবৎ এবং চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে পাঠান। তিনি তাদের ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দেন। কেননা তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ ছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় না দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর সেনাদল মক্কাভিমুখে রওনা হয়ে মক্কার কাছাকাছি এলে মক্কাবাসী বিশাল দল দেখে আত্মসমর্পণ করে। আর রাসুল (সা.) মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

দশম হিজরিতে বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে লক্ষাধিক মুসলমানের সমাগম হয়। রাসুল (সা.) মুসলমানদের উদ্দেশে তার ঐতিহাসিক অমর ভাষণ দান করে তাদের ইসলামি বিধি-বিধান ও হজের আহকাম শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী তিলাওয়াত করে শুনান, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে জীবনাদর্শ হিসেবে মনোনীত করলাম।’ বিদায় হজের পরবর্তী বছর রাসুল (সা.) জ্বরাক্রান্ত হয়ে আশেয়া (রা.)-এর ঘরে শয্যা গ্রহণ করেন। ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুরের পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

মহান আল্লাহ হজরত রাসুল (সা.)-এর জীবনকে আমাদের জন্য আদর্শ বানিয়েছেন। তার জীবনাদর্শের অনুসরণ ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতে আমাদের মুক্তি নেই। কেবল তার বাতলানো পথে চলতে পারলেই সম্ভব উভয় জগতে আমাদের সফলতা অর্জন করা। আমাদের প্রথম করণীয় হলো, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পুরো জীবনী বিশেষ করে তার জীবনের শেষ ২৩ বছরের জীবনী খুব গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করা। যেন আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সার্বিক ক্ষেত্রে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসরণ করতে পারি। আমাদেরকে তার প্রতিটি সুন্নত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। পরকালে তার সুপারিশ ছাড়া কারও সাধ্য নেই জান্নাতের প্রবেশ করার। তাই আসুন, আমরা এমনভাবে তার অনুসরণ করি, যেন পরকালে তার সুপারিশ লাভ করতে পারি।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION