শনিবার, ১২ Jul ২০২৫, ০৩:৩২ অপরাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত নানা রকম মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়, কথা বলতে হয়, মতামত প্রকাশ করতে হয়। এসব পারস্পরিক যোগাযোগে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ বা খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করে বসে। এ ধরনের আচরণই ইসলামি পরিভাষায় গিবত নামে চিহ্নিত, যা ইসলাম ধর্মে একটি ভয়ংকর পাপ হিসেবে বিবেচিত। গিবতকে কোরআনে ‘নিজ ভাইয়ের মৃত দেহ ভক্ষণ’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা একটি ঘৃণার প্রতীক এবং আত্মিক অধঃপতনের নিদর্শন।
গিবত এমন একটি পাপকাজ, যা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সমাজ জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি ব্যক্তি ও পারিবারিক সম্পর্ককে ধ্বংস করে, বন্ধুত্বে ফাটল সৃষ্টি করে এবং সমাজে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়। গিবতের কারণে একজন মানুষের মানসম্মান হানি হয় এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়। অথচ ইসলাম বারবার মানুষকে পরস্পরের সম্মান রক্ষা করতে, একে অপরের দোষ গোপন করতে এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছে।
গিবত থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এ জন্য প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ, আল্লাহভীতি, অহংকার ত্যাগ, নিজ দোষ সম্পর্কে সচেতনতা ও সদ্ব্যবহারে অভ্যস্ততা। শুধু তাই নয়, গিবতের মতো মারাত্মক অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে হলে ইসলামি শিক্ষার চর্চা, সৎ সঙ্গ গ্রহণ এবং ভাষা ও আচরণে সংযম প্রদর্শন করা আবশ্যক। গিবত শুধু মুখের ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং বাচনিক ভঙ্গি কিংবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়েও গিবত হয়ে থাকে। গিবত থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
কোরআন-হাদিসের বাণী স্মরণ করা : যখন কারও গিবত করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে তখনই কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত গিবতের কঠিন পরিণতির কথা স্মরণ করতে হবে। এতে গিবত করার প্রবণতা আর জাগ্রত হবে না। যার গিবত করা হবে তার পাপ গিবতকারীর আমলনামায় দেওয়া হবে এবং গিবতকারীর পুণ্য যার গিবত করা হয়েছে তার আমলনামায় যোগ করে দেওয়া হবে। এভাবে গিবত করার কারণে গিবতকারীর পাপের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং পুণ্যের পরিমাণ কমতে থাকে, পরিণতিতে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। এ ভীতিপ্রদ ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে গিবত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার উপায়।
এ ছাড়া যখন কারও গিবত করার ইচ্ছা হবে, তখনই নিজের মধ্যকার লুকায়িত দোষগুলো স্মরণ করলে অপরের দোষত্রুটি চর্চার আগ্রহ থাকবে না। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য যাকে তার নিজের দোষত্রুটি অপরের দোষত্রুটির আলোচনা থেকে বিরত থাকে।’
অপর এক হাদিসে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দাও, যে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি খোঁজার সুযোগ পায় না।’ (সহিহ আল জামি)
হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা : গিবত থেকে বাঁচতে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই মানুষ একে অপরকে ঘৃণার চোখে দেখে। আর যখন একে অপরের সঙ্গে খারাপ মনোভাব তৈরি হয়, তখনই মানুষ গিবতে লিপ্ত হয়। অতএব আমাদের উচিত গিবতকে পরিহার করার জন্য হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
অহংকার থেকে বিরত থাকা : অহংকার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মহান আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। অহংকারের কারণে মানুষ অপরকে তুচ্ছজ্ঞান করে এবং গিবতে জড়িয়ে পড়ে।
অপরকে তুচ্ছ না ভাবা : নিজেকে মহান আল্লাহর নগণ্য বান্দা ভাবতে হবে এবং অপরকে বড় হিসেবে দেখতে হবে। কেননা নিজেকে বড় ভাবা এবং অপরকে ছোট ভাবা থেকে অনেক সময় গিবত হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে, কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। আর কোনো নারী যেন অপর নারীকেও উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে।’ (সুরা হুজুরাত ১১)
অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকা : অনর্থক কথা ও অযথা সময় নষ্ট করা থেকেই গিবতের সূত্রপাত। তাই গিবত বা পর দোষচর্চার মতো মারাত্মক অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য অনর্থক কথা ও অযথা সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বিরত রাখতে হবে। যে সময়টুকু অবসর পাওয়া যায় সে সময়টুকু মহান আল্লাহর জিকিরে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে এর দ্বারা একদিকে নিজেকে গিবত থেকে বিরত রাখা যাবে, আবার অপরদিকে মহান আল্লাহর জিকির করার কারণে অসংখ্য সওয়াবও অর্জিত হবে।
ধর্মীয় জ্ঞান অনুশীলন : ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবেই আমরা নিজেদের অজান্তে গিবতে লিপ্ত হয়ে পড়ি। ধর্মীয় জ্ঞান থাকলে গিবত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
লজ্জা ও অপমানের কথা স্মরণ রাখা : গিবত করার ইচ্ছা হলে তৎক্ষণাৎ কেউ যদি এভাবে চিন্তা করে যে, অমুক আমার গিবত করলে যেমন আমি লজ্জিত ও অপমানিত হবো, তদ্রুপ আমিও যদি কারও গিবত করি তাহলে সে লজ্জিত ও অপমানিত হবে, কাজেই এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।
অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা : যেসব সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব গিবত করাকে কোনো দোষেরই ব্যাপার মনে করে না, এমন সব সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা উচিত।
যাচাই-বাছাই করে কথা বলা : আমাদের নিকট শোনা বা লিখিতভাবে যেসব খবর পৌঁছে থাকে, তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে বৈধ পন্থায় অপরের কাছে বলার এবং পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে। কেননা এতে মিথ্যা কথা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তাই প্রচার করে।’ (সহিহ মুসলিম)
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর