শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিক্ষাঙ্গন

মো: নাসির উদ্দিন

মো: নাসির উদ্দিন:

অনেক অবহেলা অযত্নের পরও শিশুর প্রথম প্রেম তার স্কুল। বাড়ির বাইরে তার প্রথম ঠিকানা। প্রিয় গন্তব্য। বিদ্যালয়ের দরজা শিশুর আনন্দ জগতে প্রবেশের দ্বার। যে স্কুলে শিশুরা নিরাপত্তা আর সম্মানের পরিবেশ পায়, যেখানে শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আর সংযোগ গড়ে উঠে, সেখানে শিশুদের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা বিকশিত হয়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সমীক্ষা থেকে জানা যায়-শিশুর জীবনে পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তার স্কুল জীবন। স্কুলের পরিবেশ যদি ইতিবাচক হয় এবং শিশুদের আচরণ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়, তাহলে বাড়ির পরিস্থিতি অনুক‚ল না হলেও শিশু ভালো লেখাপড়া করে। অর্থাৎ একটি প্রতিক‚ল পারিবারিক আবহ থেকে আসা শিশুও স্কুলের ভালো পরিবেশ দ্বারা অনেকাংশে উজ্জীবিত হয়। আমাদের ভাবতে হবে, কোন পথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করার দায় ও দায়িত্ব শিক্ষক মহোদয়গণের । কেননা শিক্ষাই জাতির মেরুদ›ড হলে, শিক্ষক হয় শিক্ষার মেরুদ›ড। শিক্ষার শিরদাঁড়া যেন সোলার লাইটের লাইটপোষ্ট। আর তা থেকে যে আলো ঠিকরে বেরোয় তা-ই শিক্ষক। শিক্ষক এভাবে নিজেকে নিজে না চিনলে শিক্ষায় যে ক্ষত তা শুকাবেনা ।
মন আমার পীড়িত হয় যখন দেখি গাইড বই বিদ্যার বাজারে এখনো আছে । গাইড বই শিক্ষার্থীকে মিসগাইড করে। এর আকাল বিদ্যার আলয়ে অন্ধকার ছড়ায়। পাথরকে ঘষে ঘষে মসৃণ করলে আগুনের ফুলকি ছড়ায়। তেমনি গাইড বইয়ের বিপরীতে পাঠ্যপুস্তকের পাঠে ছড়ায় আলো। চিন্তন দক্ষতা দীপ্ত হয়। ভাব সম্পদ হয় সমৃদ্ধ।

শিক্ষার্থীকে গাইড বা অন্যের আনুকূল্য ছাড়া আপন শক্তিতে প্রশ্নোত্তর খোঁজ করে নিতে সাহসী করে তুলতে হবে। তারা চারপাশে যা কিছু দেখে তা নিয়ে চিন্তনে ও ভাবনায় তারা নিজেরাই নিজেদের পথ খুঁজে নেবে। তাদের দৃষ্টি হবে অনুসন্ধানী। উদ্ভাবনার চর্চা শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানী হিসেবে দাঁড় করতে পারে।

একটি কথা মনে রাখা দরকার শিক্ষার্থীর সাফল্য শিক্ষক ও মা-বাবার উভয়ের প্রচেষ্টার ফসল। তাই কম সময়ের ব্যবধানে শিক্ষক-অভিভাবক সমাবেশ প্রয়োজন। গাইড বই ব্যবহার না করলে, প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় সন্তানের ফলাফল ভাল হবেনা- অভিভাবকদের এমন ধারনা দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়কে দায় নিতে হবে। দায় নিতে পারলে দীনতা দূর হয়। এরূপ অন্যের দায় নিজ কাঁধে তোলে জার্মানী চ্যানচেলর উইলিব্রান্ট টাইমস পত্রিকার কভার পৃষ্ঠায় ম্যান অব দ্যা ইয়ার হিসেবে স্থান করে নিয়েছিলেন। সে স্থান আপনাদের জন্য হবেনা কেন?

উত্তর পত্র(Answer Script)পরীক্ষণ পদ্ধতির সংস্কার আবশ্যক। শিক্ষার্থীর আত্মদর্শন থেকে উৎসারিত উত্তরকে উচ্চ মূল্যমানে মূল্যায়ন না করলে গাইড বা প্রাইভেট পড়া থেকে শিক্ষার্থী-অভিভাবককে ফেরানো যাবেনা। শিক্ষায় ভয়ংকর পরিস্থিতি যা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হলো গাইড বই ও প্রাইভেট নির্ভরতা যা শ্রেণী পাঠে মনসংযোগে বাধা তৈরি করছে। শ্রেণী পাঠের প্রয়োজনের পারদ দিনে দিনে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর মনোযোগ তৈরিতে পড়ছে ভাটির টান ।

আমাদের জানা থাকা দরকার-পরিবার, সমাজ ও স্কুল একসঙ্গে একটি সিরিজ হিসেবে কাজ করে। এই তিনটির কোন একটি দুর্বল হলে বাকি দুইটি অস্স্থু হয়ে পড়ে। আবার কোন একটি সবল হলে অপর দুইুটি অধিকতর সুফল ভোগ করে। সব কয়টি সক্ষমতায় থাকলে শিশুর শক্তি সুষম হয়। সুষম খাবার স্বাস্থ্যকে যেমন পুষ্ট করে, সুষম বিকাশ তেমনি শিশুকে পরিপুষ্টি দান করে। সমাজকে রাখে সৌম্য-সুন্দরের সহ অবস্থানে। এরূপ সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষার্থীর অন্তর ভ‚মির নরম মাটিতে বন্ধনের বীজ বপন করা চাই। সে বীজ-বৃক্ষ দেশ ও সমাজের জন্য হতে পারে শীতল ছায়া। তাতে দেশ সংহতি ও সমৃব্ধির সড়কে চলার পথ খুঁজে পাবে। মানুষের মানবিক উন্নয়ন উজানে অগ্রসর হবে। সহিংস সমাজ ও বিভেদের জনপদের ক্ষতে তা হবে কার্যকর মলম। এ মলমের ব্যবহার দেরী না করে আজকেই শুরু করি। অঝোর বৃষ্টি শুরু হয় এক ফোটা বৃষ্টি দিয়ে। সেরূপ সমাজ দেহের সুস্থতা শুরু করা যায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির চাষাবাদে। বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান যারা প্রযোজনা করেন তারা সাধারনত; নাচ গান ইত্যাদি শিল্পকলাকে সংস্কৃতি মনে করেন। সংস্কৃতি মূলত সমৃব্ধ জীবন বোধের অর্জন। জীবনকে সুন্দরভাবে যাপন। জীবন ও জগতকে উপভোগের সামর্থ্য অর্জন। শিল্পকলা তার বাহিরের পরিচ্ছেদ। ঝিনুকের ভেতরের মুক্তাটি সংস্কৃতি।

শিক্ষায় অদক্ষতার মহামারি চলছে। ফলে দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার যুবকের ভিড়। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পিটিআই এর প্রশিক্ষণ কোর্স২০১০ সাল থেকে ১২ মাসের জায়গায় ১৮ মাস করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক খবরে জানা যায় প্রশিক্ষণকাল সংকুচিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ যেন। একদিকে জনবলের দক্ষতা বাড়ানোর সময় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে অপরদিকে অত্যন্ত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমশক্তি আমদানি করা হচ্ছে। বিষয়টি পীড়াদায়ক। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স সীমিত না করে সংবৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রের আরো করণীয় আছে। তারা প্রাণিত হলে শিশুর শিখণে প্রাণরস সঞ্চারিত হতে পারে। পুলিশের বীরত্বের পদক পাওয়া অপ্রাপ্য বলবোনা। শিক্ষকের শিখণ পারদর্শিতাতেও অনুরূপ প্রনোদনা প্রয়োজন। পদক আর পরিপোষণ বেশি প্রয়োজন। পদক জয় War জয়ের মতো যার আগে Battle জয় করতে হয়। এ স্থানে উত্তীর্ণহওয়ার জন্য শিক্ষককে জ্ঞান-দক্ষতা-মনোভঙ্গিতে (KSA) যোগ্য হওয়া চাই। এক্ষেত্রে দারিদ্র যা দৃষ্টি গোচর হয় তা হল শিক্ষকের মনোভঙ্গির জায়গা। মনোভঙ্গি মেরামত করলে শিখণ শেখানো কাজে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে। তার জন্য শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের কাছে নিজের ভুল স্বীকারের ক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া দরকার। শিক্ষকও ভুল করতে পারে। ভুল স্বীকারে শিক্ষার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেনা বরং সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। প্রথাগত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরাই জিজ্ঞাসিত হয়। তাদের জিজ্ঞাসা করার সুযোগ নিতান্তই কম। উন্মুক্ত চিত্তে ও খোলা মনে বলা দরকার শিক্ষার্থীদের কিছু জিজ্ঞাসা আছে কিনা। জিজ্ঞাসায় শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহনের সুযোগ পেলে পঠন-পাঠন অংশগ্রহন মূলক ও ইন্টারএকটিভ হয়। এরূপ শিক্ষা সংস্কৃতিতে শিক্ষার্থীরা হয় আত্মবিশ্বাসী । আপনারে বিশ্বাস শুধু স্বপ্ন দেখায়না। স্বপ্নকে উদযাপন করতেও শেখায়। শিক্ষকের স্নেহমাখা মুখে যে-ই ক্লাসে ঢুকে তার পাঠ গেলার আগেই শিক্ষার্থী- মন খুশিতে খেলতে থাকে খিল খিল করে। পাকস্থলিতে পাঠ হয় সহজ পাচ্য। তাই শিক্ষার্থীর দুষ্টুমিতেও (অনিষ্ঠ নয়)হাতে-মুখে-চোখে শিক্ষক রাগ-রোষ দেখাবেনা। মনে রাখতে হবে- যে দুষ্টু সে-ই তার সেরাটি মুক্তির সংগ্রামে সবার আগে সমর্পন করতে পেরেছে। আয়েশী, বিলাসী আর অভিজাত সন্তানেরা বিরত ছিল যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় – ফ্রান্সের স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল দুষ্টু ছেলেরাই ।

আমাদের বিদ্যালয় গুলোতে শিশুরা ৫-১০ বছর পড়া লেখা শেষ করে ইংরেজিতে ভালতো নয়; ভাল বাংলাও বলতে পারেনা। কিন্তু আমাদের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ কোন দেশের প্রবাসী হয়ে ৩-৬ মাসের মধ্যে সে দেশের ভাষায় স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারে। যোগাযোগ করতে পারে নির্ধিধায়। শিক্ষকদেরকে প্রচলিত প্রশিক্ষণে নানা বিষয়ে দক্ষ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভাষা যে মানুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যোগাযোগের চকমকি হাতিয়ার এবং উপস্থাপনের অলংকার সে কথা আমরা ভুলে বসেছি। এমনকি আমরা না জানি বাংলা না জানি ইংরেজি রবীন্দ্রনাথের এমন অনুতাপের উচ্চারনেও ভাষার শুদ্ধ চর্চায় থেকেছি সেকেলে। ভাষার ওপর আমাদের দুর্বল দখল আন্তঃজার্তিক শ্রম বাজারে আমাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে। এই ইঙ্গিত বিশেষতঃ ইংরেজি ভাষাকে নিয়ে। ভাষার পঠন-পাঠনে,উচ্চারণ-উপস্থাপন-ও বলার অভিব্যক্তির উন্নয়নকে অগ্রাহ্য করা যাবেনা। প্রকাশের গতি-যতি, উচু-নিচু লয়-জ্ঞান ও স্বরাঘাতে সবল কথক হবে আমাদের শিশুরা। মনে রাখতে হবে ভাষার উন্নয়ন আপনিতে হয়না। ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর উন্নত ভাষা চর্চা ও ব্যবহারে ভাষার উন্নয়ন ঘটে। এ প্রেক্ষিতে উপজেলার রির্সোস সেন্টারে শিক্ষকদের জন্য ভাষা শেখার কোর্স চালু করা যায়। মানুষ মাত্র-ই চোখ নিয়ে জন্ম গ্রহন করে। কিছু মানুষের চোখ থাকলেও দৃষ্টি নেই। যাদের দৃষ্টি আছে বিষয় গুলো বোধ করি এড়িয়ে যাবেননা।

লেখক: সাবেক পিটিআই সুপার, কলামিস্ট ও শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রামের কনসালটেন্ট

ভয়েস/জেইউ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION