রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:০৪ পূর্বাহ্ন
ফাইল ছবি আবদুল আজিজ:
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভারি অস্ত্রের একটি চালান প্রবেশ করেছে। এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের। মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠি আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ নেতা ওস্তাদ খালেদের নেতৃত্বে অস্ত্রের চালানটি খালাস করা হয় বলে ক্যাম্পের একটি গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে। ইতিমধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে সাড়ে ৪শ’ ‘আরসা’র সদস্য সক্রিয় রয়েছে। ফলে সহিংসতার আশংকায় ক্যাম্প জুড়ে নজরধারি বাড়িয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাম্পে দায়িত্বরত ‘এপিবিএন’ পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ৭ জুলাই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ব্লক-বি-১৭-১৮ সংলগ্ন এলাকায় ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও)’ও মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এঘটনায় আরসার ৫ সদস্য নিহত হওয়ার পর ভারি অস্ত্র সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠে ‘আরসা’র সদস্যরা। এর পর থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে ‘আরসা’র প্রায় শতাধিক সন্ত্রাসী উখিয়াস্থ বিভিন্ন ক্যাম্প, টেকনাফস্থ উনচিপ্রাং ও চাকমার কুল ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এসময় রোহিঙ্গা নারী ও শিশু ব্যবহার করে প্রায় ১০টি অকে-৪৭ ক্যাম্পে প্রবেশ করিয়েছে। উক্ত অস্ত্র চালানে নেতৃত্ব দিয়েছেন আরসার কমান্ডার ওস্তাদ খালেদ।
তবে র্যাব সূত্র বলছে, সম্প্রতি ‘আরসা’র শীর্ষ কমান্ডার ওস্তাদ খালেদের অন্যতম সহযোগি ও ‘আরসা’র সামরিক কমান্ডার নুর মোহাম্মদ সহ ৬ নেতাকে অস্ত্র সহ গ্রেপ্তারের পর কোনঠাসা হয়ে পড়েছে আরসা। কারণ, গ্রেপ্তারকৃত কমান্ডার নুর মোহাম্মদ ‘আরসা’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও কুমপো/কারাতে পারদর্শী ছিলেন। এছাড়াও ক্যাম্পে সংগঠন আরসা’র অর্থ সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার নুর মোহাম্মদ। নুর মোহাম্মদ গ্রেপ্তারের পর ‘আরসা’ এখন অনেকটা দুর্বল।
সম্প্রতি এক প্রেসব্রিফিংয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নবাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ‘আরসা’র গোপন আস্তানা থেকে সামরিক কমান্ডার নুর মোহাম্মদ সহ গুরুত্বপূর্ণ ৬ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব নেতারা ক্যাম্পে প্রতিদিন অস্ত্র, মাদক, স্বর্ণ চোরাচালান, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যা, ধর্ষণ সহ নানা অপরাধ সংঘঠিত করছে।
খন্দকার আল মঈন আরও জানান, ‘মিয়ানমারের এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠি সীমান্তে অস্ত্র, স্বর্ণ ও ইয়াবা চোরাচালান করে সংগঠনের জন্য অর্থ জোগাড় করে। এছাড়াও ক্যাম্প ভিত্তিক যেসব অপরাধী মাদক কারবারের সাথে জড়িত, তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয় প্রতিনিয়ত। হত্যা, ধর্ষণ ও অস্ত্রবাজি এসব সন্ত্রাসীদের জন্য নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার।
জানতে চাইলে ক্যাম্পে নিয়োজিত ১৪নং ‘এপিবিএন’ পলিশের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘ক্যাম্পে অস্ত্র আছে এটা সত্য। তবে একে-৪৭ এর মত ভারি অস্ত্র আছে কিনা জানা নেই। থাকলে তো আমরা উদ্ধার করতাম। কারণ, আমি জয়েন্ট করার পর গত ৪/৫ মাসে ২০টির অধিক অস্ত্র উদ্ধার আছে। সেখানে এখন পর্যন্ত ভারি অস্ত্রের সন্ধান আমরা পায়নি। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ওয়ান স্যুটারগান, ইন্ডিয়ান পিস্তল সহ দেশীয় তৈরী আগ্নেয়াস্ত্র।’
সৈয়দ হারুন অর রশীদ কক্সবাজার ভয়েসকে আরও জানান, ‘ক্যাম্প জুড়ে ‘আরসা’র পাশাপাশি ‘আরএসও’র সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সন্ত্রাসীরা। প্রায় ১১ লাখ বিশাল জনগোষ্ঠির মধ্যে ঠিকানা বদল করে নানা কৌশলে তারা ক্যাম্পে আছে। তাদের ধরতে আমার ১৪নং ‘এপিবিএন’ পুলিশ সহ আইনশৃংখলা বাহিনী কাজ করছে।’
২০১৭ সালের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সেদেশের সেনাবাহিনীর নানা নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন রোহিঙ্গারা। এরপর থেকে বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সাথে মিশে যায় মিয়ানমারের আরকান ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠি ‘আরসা’ ও ‘আরএসও’ সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন। পরে ধীরে ধীরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রতিদিন অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুনোখুনি, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক, স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাচালান সহ নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে ক্যাম্পে। চলছে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দু’গ্রুপে গোলাগুলি। ক্যাম্পে নিয়োজিত আইনশৃংখলা বাহিনীর নানা তৎপরতা থাকলেও তা তোয়াক্কা করছেন সন্ত্রাসীরা।
ক্যাম্পের একাধিক সূত্র বলছে, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, লম্বাশিয়া, ঘোনারপাড়া, কুতুপালং, জামতলী, মধুরছড়া, টেকনাফের শালবনিয়া, লেদা সহ বেশকিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অভারণ্যে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালান, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে গ্রুপে গ্রুপে গোলাগুলি। প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, অপহরণ সহ নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে ক্যাম্প গুলোতে। বিশেষ করে ক্যাম্পে যেসব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমন্বয়ের কাজ করে তাকেই টার্গেট করে খুন করে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভয় ও আতংক বিরাজ করছে।
আইন শৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, গত ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮৮ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই খুন হয়েছে আরসার হাতে। বর্তমানে এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে অন্তত ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠি আরসার সদস্য সক্রিয় রয়েছে। তাদের ধরতে আইনশৃংখলা বাহিনী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পে ‘আরসা’ ও ‘আরএসও’র মধ্যে বড় ধরণের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হত্যা ও অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। তাই, বড় ধরণের সহিংসতা থেকে রক্ষা পেতে আইন প্রয়োগকারি সংস্থাকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করার আহবান জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
ভয়েস/আআ