মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৪৩ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
নির্বাচন ও ভোট আয়োজনে ইসির কর্মযজ্ঞের মধ্যেই, এটা না সেটার বাগড়া। একটা নিষ্পত্তি হতে না হতেই আরেকটা। সদরে নানা কিছুর মধ্যে, অন্দরে বিদেশিদের হাতে বন্দরের ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দেওয়া নিয়ে নানা বয়ানও কম নয়। মনোনয়নসহ নির্বাচনী দৌড়ে এখানে-ওখানে সংঘাত চলছে। ঘটছে প্রাণহানিও। আদালতে হাজিরা দিতে এসেও লাশ হতে হয়েছে। তারপরও নির্বাচন বলে কথা। কে জিতবে, কে কোন কৌশলে গোল দেবে এসব গসিপের মধ্যে দেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে জটিলতা, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ ইত্যাদির মতো গম্ভীর বিষয়ও যোগ হচ্ছে। কিন্তু, বয়ানের ভিন্নতায় মাঝেমধ্যে তা গসিপের মাত্রা ছাড়িয়ে গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য তা নির্বাচন কমিশনের কাজে ছেদ ফেলতে পারছে না, ইসিও তার কাজে ক্ষ্যান্ত দিচ্ছে না কোনো ঢিলেমিও নেই। পুরোদমে চলছে নির্বাচন আয়োজন। আর এবার নির্বাচন মানেই কেবল নির্বাচন নয়। সঙ্গে গণভোটও। নতুন যোগ হয়েছে প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনা। ইসি সারা দেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র এবং ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি ভোটকক্ষ (বুথ) নির্ধারণ করেছে। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে ভোটকেন্দ্র বা ভোটকক্ষ বাড়াতে হবে কি না, সে প্রশ্ন ছিল। শনিবার ঢাকায় মক ভোটিং বা ভোট মহড়ায় প্রাথমিকভাবে পাওয়া উপাত্ত থেকে ইসি মনে করছে, একটির জায়গায় দুটি গোপন কক্ষ করা হলে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে না। ইসি মূলত বুঝতে চেয়েছে, ভোট দিতে কত সময় লাগে এবং ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে কি না। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, ভোটকেন্দ্র বাড়ছে না বাড়তে পারে বুথ। এমন আরও নানা ভাবনা-চিন্তায় একটি অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের ভরসা খুঁজছে ইসি।
এ আশা আরও অনেকের। বাংলাদেশে নির্বাচন তো একসময় সামাজিক উৎসবের মতোই ছিল। গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে, রাজনৈতিক দলগুলো শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামত না, মানুষকে নিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশও তৈরি করত। নির্বাচনী মিছিল মানেই ছিল উচ্ছ্বাস, গান, পোস্টার লাগানো, চায়ের দোকানে উত্তপ্ত আলোচনা, আর সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা রকম আশা-আকাক্সক্ষার কথা বলা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই উৎসব-আনন্দ যেন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। গত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ভয়, দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস এবং ব্যাপক অনিয়মের স্মৃতি। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাচনী পরিবেশ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, মানুষ নির্বাচনকে আর উৎসব মনে করত না; বরং অনেকেই নির্বাচনের দিন ঘর থেকে বের হতে ভয় পেত। কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি, বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হামলা এসব যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল। চব্বিশ সেখানে ছেদ ফেলেছে। অনিয়ম আর ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের পর মানুষ এক ধরনের মুক্তি অনুভব করেছে। সেই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবর্তন এসেছে, আর সেই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের মনে ফিরে এসেছে সেই পুরনো নির্বাচনী উৎসবের স্মৃতি, সেই প্রত্যাশা। মানুষ আবার আশা করতে চাচ্ছে, নির্বাচন যেন তাদের ভোটে, তাদের অংশগ্রহণে হয়। কিন্তু, বছরের পর বছর ধরে নির্বাচনকে ঘিরে যে অনিয়ম-সহিংসতা চলেছে, তা রাতারাতি দূর হয়ে যাবে?
এ ধরনের প্রশ্ন ও সংশয়ও ইতিবাচক। কারণ প্রত্যাশা থাকাতেই আসছে প্রশ্নগুলো। তা কেবল শিক্ষিত বা শহুরে নয়, তৃণমূলেও। এটা মৌসুমি ভাবনা হলেও এবারের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা একটু ভিন্ন। পেশাদার ও সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদরা গা-ঝাড়া দিচ্ছেন। মঞ্চে বক্তারা তেতে উঠছেন। সদর রাস্তা মাড়িয়ে অলিগলিতেও চলছে শোডাউন। আর এটাই স্বাভাবিক এবং ইতিবাচকও। চব্বিশ দেশের রাজনীতিতে একটা কড়া বার্তা দিয়েছে। রাজনৈতিক সুনামি বয়ে গেছে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে। তা ধারণ করা, না করা আরেক বিষয়। এখন অনেকেই তা ভুলতে থাকলেও চব্বিশ দায়ী নয়। চব্বিশের চেতনাও মিথ্যা হয়ে যায়নি। চব্বিশের জুলাই আন্দোলন সোয়া বছর পেরোতে না পেরোতেই যে দেশ আবার আগের পথেই চলতে শুরু করেছে, এর জেরেও একদিন ভুগতে হবে। তাই বলে আবার চব্বিশের ৫ আগস্টের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া? উল্টাপাল্টা কথার খই ফোটানো? এ কাজে তো কেউ কাউকে পেছনে ফেলতে চান না। সবার মধ্যেই ফার্স্ট হওয়ার উগ্রতা। বড় দল হিসেবে তা বিএনপিকে দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। না পারছে কড়া জবাব দিতে। না পারছে একদম চুপ থেকে ওয়াকওভার দিয়ে দিতে। দলটির পক্ষে কীভাবে নির্বাচনে জামায়াতকে ভোট দেওয়া আর জান্নাতে যাওয়া সমার্থক ফতোয়ায় সায় দেওয়া? যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, বসবে, গ্রেপ্তার করবে, মামলা করবে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর এমন বয়ানের সমালোচনার সময়ও বিএনপির নেই। দলটির চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফিরতে বেদনাদায়ক জটিলতা। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচনেও কি বড় রকমের বাধা বা বাগড়ায় পড়তে হবে বিএনপিকে? ডিপ স্টেট কী ভূমিকা নেয় সেই ভাবনা তাদের ভাবতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো মাইনাস রাজনীতির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে কি-না, আক্রান্ত দল হিসেবে তাদের তা ভাবনায় রাখতেই হচ্ছে। রাজনীতির অন্দর মহলের অনেকে অনুমান করছেন, জুলাই সাদা চোখে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটালেও সেই মাইনাস পলিটিক্স জারি রেখেছে। বা ফিরিয়ে এনেছে। নইলে তারেক রহমানের ফেরা নিয়ে এত ক্যাচাল কেন? তা প্রায় সবারই জানা, লন্ডনের ডাক্তাররাই বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা টিমের অন্যতম সদস্য। তার অবস্থা আরেকটু ভালো হলে, ট্রাভেল করার অবস্থা হওয়া মাত্র খালেদা জিয়াকে লন্ডন নেওয়া হবে। ওখানেই কয়েক মাস আগে উনার চিকিৎসা হয়েছে। ফলে এ সময়ে তারেক রহমান বা তার ডাক্তার স্ত্রী কেন দেশে নেই তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। আর যার অসুস্থতা নিয়ে কথামালা হচ্ছে, তিনি এখন আর দলের নন। ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মানে-মর্যাদায় দলের ওপরে চলে গেছেন আরও আগেই। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হওয়ার সংবাদে সারা দেশে জনগণের মধ্যে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে হয় না। হাসপাতালে মুমূর্ষু খালেদা জিয়ার প্রতি দেশবাসীর যে সহানুভূতি, এতে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এই অকৃত্রিম ভালোবাসা তার অর্জন।
ছোট্ট গৃহকোণ থেকে রাজনীতির সুপরিসর প্রান্তরে আসার সময় খালেদা জিয়ার বয়স ৩৭ বছর। তার স্বামী জিয়াউর রহমানও ৩৭ বছর বয়সেই সমস্ত ভয়ভীতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা দেন। নিজের এবং পরিবারের জীবনকে থোড়াই কেয়ার করে দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। জিয়াউর রহমান সেই ভাগ্যবান। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে, বন্দিত্বের নিপীড়নকে সঙ্গী করে বেগম খালেদা জিয়াও ভিন্ন উচ্চতায়। আপডেট তথ্যে জানা গেছে, তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসকদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। আগের তিন দিনের চেয়ে এটিকে ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকরা। তা কেবল তারেক রহমান নয়, দেশের অনেকের জন্যই সুখবর। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে দোয়া-প্রার্থনা অব্যাহত রয়েছে। এমন একটা অবস্থায়ও মায়ের অসুস্থতাকে সাবজেক্ট করে তারেক রহমানকেও সাবজেক্ট করে ফেলার পেছনে রাজনীতি নয়, অতিরাজনীতি কাজ করছে। কিছু রাজনীতি তো থাকতেও পারে। থাকাই স্বাভাবিক। তারেক রহমান কেবল বাংলাদেশের রাজনীতির তারকা নন, তাকে থ্রেট মনে করার দেশি-বিদেশি শক্তিও আছে। তা মোকাবিলা করেই তিনি রাজনীতি করবেন সেটা বিবিসির সাক্ষাৎকারে এক রকম পরিষ্কার করেছেন তিনি। তার এ রিস্ক হয়তো জনমভরই থাকবে। সব চেয়ে ধ্রুব সত্য হচ্ছে, গত দুই দশক ধরে এখানকার কিছু গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তারেক রহমানকে নিয়ে ফেরি করা বয়ান এখনো চলছে। কেবল কিছু শব্দ বদলেছে মাত্র। সেসব নসিহতের ভাষা-ভঙ্গি সাধারণ-সাবলীল, যে কারও পক্ষেই বোধগম্য। কোনো সন্তানের মায়ের প্রতি সীমাহীন মমতার কথা জানিয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা, আকুলতা ও অসহায়ত্ব জানানোর পরও বয়ান ও ন্যারেটিভ তৈরি করা চরম জঘন্য কাজ। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে ব্যক্তিগত আবেগের চেয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন বেশি প্রাসঙ্গিক।
এখানে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি দেখানোর পেছনে কাজ করছে আরেক মতলববাজি। সেটাও আবার একটা আকাক্সিক্ষত-প্রত্যাশিত নির্বাচন সামনে রেখে। যা নির্বাচনের এমন চলতি পথে নানা ধরণের যদি, তবে, কিন্তুর ফের তৈরি করছে। খটকার পর খটকা লাগছে। এমন অবস্থার মধ্যে দশ কথার এক কথা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। সুষ্ঠু নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক সহায়তা চেয়েছেন তিনি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, এ আশাবাদের কথাও জানান। এর দিনখানেকের মাথায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনকে যাবতীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত তার বাহিনী। উভয়ের কথা সোজাসিধা, বার্তা একদম পরিষ্কার। যার যা ইচ্ছা বা মনে করার অপশন আর নেই। তবে, যদি, কিন্তুরও কিছু নেই। একদিকে সামনে আকাক্সিক্ষত নির্বাচন, আরেক দিকে শুরু হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য-গর্বের বিজয়ের মাস। এবারের বিজয়ের মাস উদযাপন হবে ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। শহীদদের আত্মত্যাগে জুটেছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। তাই ডিসেম্বর মাস বাঙালি জাতিসত্তা আর নিজস্ব ভূমির গৌরবদীপ্ত বিজয় ও অহংকারের মাস। এখানে আবেগের অনেক বিষয়-আশয় রয়েছে। বিজয়ের মাস এবং নির্বাচনের এ সময়ে অতিকথন, অতিবয়ান কাম্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর