বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভুটান শিক্ষার্থীদের জিডিপি শেখায় না শেখায় হ্যাপিনেস

সাদিয়া জাফরিন:
ভুটানের শিক্ষাক্রম নিয়ে একটি বই পড়ছিলাম। দেশটির ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রীর লেখা ‘আমার সবুজ বিদ্যাপীঠ’। শুরুতে ভেবেছিলাম বইটি পরিবেশ, গাছপালা কিংবা স্কুলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বিষয়ে আরও বেশি চিন্তাশীল করে গড়ে তোলা যায় সম্পর্কিত হবে। কিন্তু পড়া শুরুর পর বুঝলাম আমার ধারণা পুরোপুরি ভুল ছিল। এই বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ওরা শিক্ষার্থীদের জিডিপি শেখায় না, বরং শেখায় ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ)’।

গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস কী? মোট জাতীয় সুখবোধ হলো একটি দেশের নাগরিকদের মানসিক ও সামাজিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রস্তুত করা। আর এর কাজ শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ তারা মাথাপিছু আয় চিন্তা না করে চিন্তা করতে শেখে সবাই মিলে সুস্থভাবে সুখে শান্তিতে সবুজের মাঝে কীভাবে বাঁচা যায়। তারা শেখে ব্যাংকে টাকা জমানোই জীবনের একমাত্র ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য টাকার পাশাপাশি বা তার চেয়ে বেশি আমাদের প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এই সাধারণ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বোধের বীজ ভুটানের শিশুদের অন্তরের গহিনে এমনভাবে রোপণ করে দেওয়া হয়, যা তারা সারা জীবন লালন করে। আর তাই ভুটানই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা কার্বণ নেগেটিভ; অর্থাৎ ওরা পৃথিবীতে কোনো কার্বন ডাই-অক্সাইড যোগ করছে না।

শুধু একবার বর্তমান সময়ের তাপপ্রবাহের কথা চিন্তা করেন। বাংলাদেশের শিশুদের যদি স্কুলে শেখানো হতো গাছ কেটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বাড়িতে লাগালে তুমি ঘরের মধ্যে আরাম পাবে ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। তাই নিজেকে ভালো রাখার জন্য প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখো। যা ভুটানের শিশুদের শেখানো হয়। ভুটানের শিক্ষাক্রমে শেখানো হয়, নীরব সময়কে কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি নিজস্ব মানোন্নয়নে; অর্থাৎ মানবিক গুণাবলিতে আমরা কীভাবে আরও উৎকর্ষ সাধন করতে পারি। বইটিতে এই বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে খুব সরল উদাহরণের মাধ্যমে। যেমন আমরা খাবার খাই ক্ষুধা নিবারণের জন্য, তাহলে উদরপূর্তি করে খেয়ে নিলেই হয়, সেটা এত সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশনের কী দরকার! আমরা জামাকাপড় পরি দেহকে আবৃত রাখার জন্য, কিন্তু সেটাকে সূচিশৈলী করার কী প্রয়োজন! আমরা সবাই যে আলাদা, আমাদের রুচিবোধ, চিন্তাচেতনা যে আলাদা, তা আমাদের এসব দৈনন্দিন আচার ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকেই বোঝা যায়। আর আমরা ব্যক্তিত্বপূর্ণ হয়ে ওঠি। ঠিক তেমনি খেলাধুলা, নাচগান, কবিতা, চিত্রকর্ম ইত্যাদি আমাদের মনের উৎকর্ষ বাড়ায়। তাই স্কুলে পড়াশোনাতে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় এই এক্সট্রাকারিকুলার একটিভিটিসকে। যাতে তারা বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে পারে, আগ্রাসী চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত না হয়। তারা তাদের সংস্কৃতিকে জানে, বুঝে এবং শ্রদ্ধা করে। তাই ভিন্নমতের মানুষের চিন্তাচেতনাকে তারা কখনো অসম্মান করে না।

বাংলাদেশের আমরা দেখি অনেক মানুষ সংস্কৃতিকে ধর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। অথচ দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে তাদের ধর্মে, তাদের উৎসব, ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতিতে ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। খুব সাধারণ উদাহরণ হলো, গ্রীষ্মকালীন দেশের মানুষেরা তাদের দেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী পোশাক পরিধান করে। আবার শীতপ্রধান দেশের মানুষ তাদের পরিবেশ এবং প্রয়োজন অনুসারে বেশি জামাকাপড় পরে। এখন আমরা যদি এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলি তাহলে তা একটি বড় ধরনের সমস্যা। বইটিতে চমৎকার সরলভাবে লেখা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার মূল কারণ হলো আমরাই একমাত্র প্রাণী, যারা কিনা ভালো-মন্দ বিচার করতে পারি। ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারি।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীটা কেমন জীবনযাপনের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা কেন? পাহাড় কি বলেছে বা কোনো অভিযোগ করেছে যে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না? বা বাতাস কি বলেছে আমি ক্লান্ত? আমি আর বইব না! নদীনালা কি বলেছে যে আমি আর মাছ দিতে পারব না? এদের তো কোনো নিজস্ব ইচ্ছা নেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কাদের আছে? বিচার করার যোগ্যতা কাদের আছে? একমাত্র মানুষের! তাহলে এই পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী বানানোর দায়িত্বটা কাদের ওপর বর্তায়? এই মানুষ, মানে আমাদের ওপরেই। তাই ভুটানের স্কুলে এই জিনিসটা খুব ভালো করে শেখানো হয় ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝা এবং তা মেনে চলা। এই যে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি এত কিছু শেখানো হচ্ছে। তাতে কি তাদের পড়াশোনার ক্ষতিসাধন হচ্ছে না? এমন অনেক প্রশ্ন অনেক সময় অভিভাবকরা করেন। কিন্তু গ্রিন স্কুলে ৫৫ মিনিটের ৬টি ক্লাস করানোর পরও একটি অতিরিক্ত ক্লাস থাকে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বাড়ির কাজ বা যে বিষয়ে সহায়তা দরকার তা নিয়ে কাজ করে। কারণ অনেকের বাড়িতেই রাতে বিদ্যুৎ থাকে না।

মজার বিষয়, এখানে পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভীতসন্ত্রস্ত করা হয় না। বরং তাদের মাঝে পরীক্ষার জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়। প্রতিনিয়ত তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, পরীক্ষার কথা উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে। উদ্দীপনা হলো, কঠোর অধ্যবসায় বা পরিশ্রমের মাধ্যমে আরও ভালো করার প্রচেষ্টা। আর শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় পরিশ্রমের প্রতি ভক্তি। শিক্ষকমণ্ডলী রাত ৯টা পর্যন্ত তাদের জন্য পাঠ পরিকল্পনাসহ অনেক কাজ করেন। তাই শিক্ষার্থীরা কখনোই পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় না। কারণ তারা শিক্ষকদের পরিশ্রমকে ভক্তি করে। আর শেষে যে কথাটি বলা আছে, ‘স্কুলকে ঘিরেই আমাদের ভাবনা, আমাদের জীবন আর স্বপ্ন। এটি আমাদের জীবনের অংশ। আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে, আমাদের মান সমুন্নত রাখতে এবং যেখানে সম্ভব সেখানে উন্নতি করতে। আমরা একসঙ্গে স্মৃতির পসরা বুনি। এটিই আমাদের স্কুলের অনুরণন।’ অর্থাৎ ভুটানে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করে, হোক সেটা নীতিমালা গঠন, কারিকুলাম সাজানো বা শিক্ষকদের প্রতিদিনের কার্যক্রম, তারা সবাই সবকিছুর ওপরে রাখে শিক্ষার্থীদের এবং সে সঙ্গে প্রকৃতিকে। এবং নিজেদের কাজকে তারা প্রতিনিয়ত উন্নত করে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, যেখানে তারা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে পারার যোগ্যতা অর্জন করবে। অর্থাৎ কেউ পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশে এত জিপিএ ৫, কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাব, এর অন্যতম কারণই হচ্ছে আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থের চেয়ে অন্য কোনো স্বার্থ নিয়ে বেশি চিন্তিত।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, গ্রো ইউর রিডার ফাউন্ডেশন

sadiajafrin24@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION