শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৭ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ইমাম আবু হানিফার সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

মুফতী মানজুর হোসাইন খন্দকার:
হজরত আলী (রা.) ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা। তার খেলাফতকালে ছোট্ট শিশু সাবিত এসেছিলেন তার দরবারে। আলী (রা.) শিশু সাবিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিলেন তার বংশধরদের জন্য। দোয়ার বীজ মহিরুহ হতে বেশি সময় লাগেনি। আলী (রা.)-এর দোয়ার পর ৮০ হিজরিতে সাবিতের বংশে নুরের বাতি জ্বালিয়ে পৃথিবীতে আসেন নুমান নামের এক তুখোড় প্রতিভার অধিকারী মানব শিশু। তার পুরো নাম নুমান ইবনে সাবিত ইবনে জুতি ইবনে মাহ। গবেষকরা বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পূর্বপুরুষরা পারস্যের সম্ভ্রান্ত বংশের লোক ছিলেন। তার মাতৃভাষা ছিল ফারসি। (ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. ২৭)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) পরিণত বয়সে বেশ কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাৎ পেয়েছেন। ফলে বিশ্লেষকরা সন্দেহাতীতভাবে তাকে তাবেয়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্লেষকরা বলেন, আনাস ইবনে মালেক (রা.), সাহল ইবনে সাদ (রা.), আবু তোফায়েল আমর ইবনে ওয়াসেলা (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা.)-সহ আরও কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে আবু হানিফ (রহ.)-এর সাক্ষাৎ প্রমাণিত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাবেয়ি হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনে সাদ, খতিব আল বাগদাদি, আবদুল করিম সামআনি, ইমাম নববী, ইমাম জাহাবি, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি ও জাইনুদ্দিন ইরাকি (রহ.)-এর লেখায়। (মানাকিবে ইমাম আবু হানিফা ২৯৬)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। তার দাদা পারস্য থেকে কুফায় হিজরত করে আসেন। ধারণা করা হয়, ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তার পরিবারের ওপর সমস্যার পাহাড় নেমে আসে। তাই তিনি ধর্ম বাঁচাতে পারস্য থেকে কুফায় হিজরত করেন। তখন ছিল চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাসনকাল।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন স্বৈরশাসক হাজ্জাজ ক্ষমতায়। এ সময়কালে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে তার। একটু বড় হওয়ার পর তিনি পৈতৃক ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করতেন। পড়াশোনা তখনো শুরু করেননি তিনি। তার ইলমি সাগরে যাত্রা শুরু হয় সুলাইমানের শাসনের সময়। এ নিয়ে একটি সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটি স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মুখেই শোনা যাক। তিনি বলেন, ‘একদিন আমি বাজারে যাচ্ছিলাম ব্যবসার কাজে। পথে কুফার বিখ্যাত আলেম ইমাম শাবির সঙ্গে দেখা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা! তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি একজন সওদাগরের নাম বললাম। ইমাম বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি, তুমি কারও কাছে পড়াশোনা করো কিনা? আমার কণ্ঠে এক রাশ আক্ষেপ ফুটে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি কারও কাছে পড়ি না। আমার জবাব শুনে ইমাম শাবি বললেন, তোমার ভেতর আমি বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তোমার অবশ্যই আলেমদের দরসে বসা উচিত। কথাগুলো আমার ভেতর ছুঁয়ে গেল। আমি এলেম সাধনার জন্য পাগল হয়ে গেলাম।’ (মানাকিবে ইমাম আজম ৫৪)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ওস্তাদদের মধ্যে ইমাম হাম্মাদ ইবনে আবু সুলাইম (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুফায় ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর মাদ্রাসা ছিল। তিনি বহু তাবেয়ির ওস্তাদ। আনাস (রা.) থেকে তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি অন্যতম ফকিহ সাহাবি ইবনে মাসউদের ফিকহ শিক্ষা দিতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) দশ বছর ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর কাছে ফিকহ শিক্ষা করেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘ দশ বছর ইমাম হাম্মাদের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। দশ বছর শেষে আমার মনে হলো, এবার আমি পড়াতে পারি। কিন্তু ওস্তাদের সম্মানে আমি পড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।’ (তারিখে বাগদাদি ১৩/৩৩৩)

ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর মাদ্রাসায় পড়ার সময়ই ইলমে হাদিসের ব্যাপারে আগ্রহী হন ইমাম আবু হানিফ (রহ.)। কেননা ইলমে ফিকহে বুৎপত্তি লাভের জন্য ইলমে হাদিসের ওপর দখল থাকা প্রয়োজন। হাদিস শিক্ষার জন্য ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কুফার আলেমদের মজলিসে বসতে শুরু করলেন। কুফার মুহাদ্দিসদের থেকে দরস শেষ করে তিনি ইলমে হাদিসের জন্য মক্কা-মদিনায় ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস আতা ইবনে আবু রাবাহ আল কুরাইশি (রহ.)-এর কাছে ইলমে হাদিস শিক্ষা করেন। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। প্রায় দুইশ সাহাবির সান্নিধ্য থেকে এলেম আহরণ করেছেন তিনি। সাহাবিরাও তার মজলিসে বসত। তিনি সাহাবিদের উপস্থিতিতে ফতোয়া দিতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হতো। এ ছাড়াও হাফেজে হাদিস আবদুল্লাহ ইবনে ইকরিমা, সুলাইমান ইয়াসার, সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.)-সহ মক্কা-মদিনার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের থেকেও ইলমে হাদিস শিখেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। হাদিসের অন্যতম সেরা মনীষী ইমাম আওজায়ী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে হাদিসের সনদ দেন।

আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন ফকিহ বা ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদ এবং হানাফি মাজহাবের প্রধান ব্যক্তি। হাদিসের জগতেও তিনি ছিলেন সম্রাট। এ জন্য ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর বিশিষ্ট ছাত্র হাফেজ আবদুর রহমান মুকরী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (রা.)-এর সূত্রে হাদিস বর্ণনা করার সময় বলতেন, ‘আখবারানা শাহেন শাহ অর্থাৎ হাদিস জগতের সম্রাট আমাদের কাছে হাদিস বর্ণনা করেছেন।’ জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস মিসআর বিন কিদাম (রহ.) বলেন, আমরা আবু হানিফার সঙ্গে হাদিস পড়েছি। এ শাস্ত্রে তিনি আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। এরপর আমরা তাজকিয়াতুন নফস তথা আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনে মনোযোগী হই। এখানেও তিনি আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। ইমাম আবু হানিফার হাত ধরেই কিতাবুল আছার নামে প্রথম সহিহ হাদিস গ্রন্থ রচিত হয়। অসংখ্য হাদিস থেকে যাচাই বাছাই করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেন। সদরুল আয়িম্মা মুওয়াফফাক ইবনে মক্কী বলেন, ইমাম আবু হানিফা ৪০ হাজার হাদিস থেকে যাচাই-বাছাই করে কিতাবুল আছার সংকলন করেন। (মানাকিবু আবি হানিফা ২৭)

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION