বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:১০ পূর্বাহ্ন
মাওলানা শেখ তারেক হাসান মাহদী:
পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ডাক মা। মায়ের মতো আপন কেউ হয় না। ফুল, পাখি, নদী, ঝরনা কোনো কিছুই মায়ের মতো মায়াবি না। দুনিয়ার অনেক রঙ আছে, অনেক আলো আছে, অনেক জৌলুশ আছে। তবে মায়ের মতো এত রঙ, এত আলো, এত জৌলুশ আর কিছুতে নেই। জীবন যখন নিরানন্দ হয়ে ওঠে, হৃদয়ের জমিন যখন শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, মা তখন আনন্দের বর্ষণ হয়ে সন্তানের মনের আকাশ ভিজিয়ে দেয়। যার মা নেই, তার সব থেকেও কিছু নেই। অন্যদিকে যার মা আছে, দুনিয়ার বাদশাহি তার কদমে লুটায়। মা বেহেশতের রানী। মা আনন্দের খনি। মায়ের সেবা অন্যতম বড় ইবাদত। একজন সাহাবি এসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওগো দয়াল নবী! আমার ভালো ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার কার? নবীজি বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কার? নবীজি বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কার? এবারও নবীজি বললেন, তোমার মায়ের। চতুর্থবার সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কার? নবীজি বললেন, তোমার বাবার। তারপর তোমার কাছের মানুষজন।’ (আল আদাবুল মুফরাদ ৩)
মা এমন এক সম্পদ দুনিয়া ও আখেরাতে যার বিকল্প নেই। বন্ধু হারালে বন্ধু পাওয়া যায়। অর্থ খোয়া গেলে অর্থ উপার্জন করে নেওয়া যায়। সম্পদ নষ্ট হলে আবার তৈরি করা যায়। কিন্তু মা একবার চলে গেলে আর পাওয়া যায় না। যতদিন মা বেঁচে থাকে ততদিন মাথার ওপর মায়ের দোয়া থাকে। জীবনে কঠিন দিনে মায়ের কাছে গিয়ে চেহারার দিকে তাকালে মনে শক্তি ফিরে আসে। সন্তানের জীবন জুড়ে মায়ের আঁচলের ছায়া যে কত লম্বা হয় মা হারিয়ে গেলে তা বোঝা যায়। যেমন বুঝেছিল এক দাগি খুনি। ঘটনাটি বলেছেন হজরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.)। একবার ইবনে আব্বাসের কাছে এক লোক এসে বড় অপরাধের ভঙ্গিতে বলল, ‘ওগো আল্লাহর নবীর পেয়ারা সাহাবি! আমি রাগের মাথায় খুন করেছি। এক রূপবতীকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিই। সে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। কিছুদিন পর অন্য একজন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। বিষয়টি জেনে আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। নিজেকে খুব ছোট মনে হতে থাকে। অপমানের আগুন আমার ভেতরকে পুড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে রাগের মাথায় আমি ওই নারীকে খুন করে ফেলি। এখন আপনি বলুন আমার জন্য তওবার দরজা খোলা আছে কি?’ ইবনে আব্বাস (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে যুবক তোমার মমতাময়ী মা বেঁচে আছেন?’ উত্তরে যুবক বলল, ‘আমার মা বেঁচে নেই।’ ইবনে আব্বাস কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘তুমি খালেস দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো এবং নেক আমলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করো।’
যুবকটি চলে গেলে বর্ণনাকারী আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তার মায়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন কেন?’ জবাবে ইবনে আব্বাস বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মায়ের সেবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো আমলের কথা আমার জানা নেই। তার মা বেঁচে থাকলে সে যদি মায়ের সেবা করত খুব সহজেই আল্লাহ তার তওবা কবুল করে নিতেন।’ (আল আদাবুল মুফরাদ ৪)
মুহাদ্দিসে কেরামরা বলেন, এ হাদিসের আলোকে বোঝা যায়, মানুষ হত্যার মতো ভয়ংকর গুনাহের কাফফারাও হতে পারে মায়ের সেবা। ইবনে আব্বাস নিজ আন্দাজ থেকে এমন ফতোয়া দেননি। বরং নবীজি (সা.)-ও একজনকে এমনটি বলেছিলেন। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে ইবনে ওমর (রা.) থেকে। তিনি বলেন, একবার এক লোক নবীজির কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহ রাসুল! আমি অনেক বড় গুনাহ করে ফেলেছি। আমি তওবা করতে চাই। আমার জন্য তওবার কোনো সুযোগ আছে?’ নবীজি বললেন, ‘যুবক! তোমার মা বেঁচে আছেন?’ যুবক বলল, না। আমার মা অনেক আগেই মারা গেছেন। তবে আমার খালা বেঁচে আছেন।’ এ কথা শুনে নবীজি বললেন, ‘যাও একনিষ্ঠভাবে খালার সেবা করো।’ হাদিসটি তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান ও হাকিম (রহ.) হাদিসটি ইমাম বুখারি ও মুসলিমের শর্তে সহিহ বলেছেন।
মাওলানা আবদুল্লাহ ইবনে সাইদ জালালাবাদি আদাবুল মুফরাদের টিকায় শরহে সুন্নাহ ও বায়হাকির সূত্রে মায়ের সেবার পুরস্কার সম্পর্কে একটি চমৎকার হাদিস এনেছেন। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিক (রা.)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি যখন মেরাজে যাই তখন সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে পাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এমন মধুর তেলাওয়াত কার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে?’ বলা হলো, ‘এটা হারিসা ইবনে নুমানের কণ্ঠ। সে ছিল পরম মা ভক্ত ছেলে।’ এতটুকু বলার পর নবীজি (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমরা হারিসার মতো মা-ভক্ত হও। হারিসার মতো মা-ভক্ত হও। অবশ্যই হারিসা অন্য সবার চেয়ে মায়ের প্রতি বেশি যতœশীল।’ এ হাদিস উদ্ধৃত করার পর মাওলানা জালালাবাদি বলেন, ‘মায়ের সেবা এমন এক ইবাদত, যা বান্দার গুনাহ ঝরিয়ে জান্নাত নিশ্চিত করে দেয়।’ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অনূদিত আদাবুল মুফরাদের টিকা ২৮)
মা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। দুনিয়াতে সফলতা অর্জন, গুনাহ মাফ এবং পরকালে জান্নাত লাভের অন্যতম মাধ্যম মায়ের সেবা-যতœ করা। তাই যাদের এই মহামূল্য সম্পদ এখনো চোখের সামনে আছে, তাদের উচিত তাকে পরম যতেœ আগলে রাখা। আপনার সেবা-যতেœ আপনার মা যদি খুশি হন, তাহলে মনে রাখবেন, আল্লাহতায়ালা আপনার জন্য জান্নাত বরাদ্দ করে রখেছেন।
ভয়েস/আআ