বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:২৮ পূর্বাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
ধৈর্য আদর্শ মানুষের একটি উত্তম চারিত্রিক গুণ। ধৈর্যের আরবি প্রতিশব্দ হলো ‘সবর’। এর অর্থ বিরত থাকা, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, সহ্য করার ক্ষমতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে তার আদেশ পালন করা এবং তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকাই ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা।
কারও মতে ধৈর্য হচ্ছে মানুষের এমন একটি গুণ, যে কারণে সে অসুন্দর ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। এটি মানুষের একটি আত্মিক শক্তি, যা দিয়ে সে নিজেকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষ কষ্ট-ক্লেশ, ব্যথা-যন্ত্রণা ও আঘাত সহ্য করতে সক্ষম হয়।
ধৈর্যের পুরস্কার জান্নাত : যেসব মানুষ বিপদাপদে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং ধৈর্যের মাধ্যমে ওই বিপদ মোকাবিলা করবে মহান আল্লাহ তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন। দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাদের সম্মানিত করবেন। ধৈর্যধারণের কারণে আল্লাহ আখেরাতে তাদের জান্নাতের মাধ্যমে পুরস্কৃত করবেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তাদের ধৈর্যধারণের কারণে তাদের পুরস্কার হবে জান্নাত ও রেশমি বস্ত্র।’ (সুরা দাহর ১২) সালমান ফার্সি (রা.) কর্র্তৃক বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত।’ (উমাদাতুল কারী ১০/৩৮৩) আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ আদায় করে, আমি তাদের যে রিজিক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের শুভ পরিণাম। স্থায়ী জান্নাতসমূহ, যাতে তারা এবং তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রীরা ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎ ছিল তারা প্রবেশ করবে। আর ফেরেশতারা প্রতিটি দরজা দিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হবে। (আর বলবে) তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, কারণ তোমরা ধৈর্যধারণ করেছ। আখেরাতের এ পরিণাম কতই না উত্তম।’ (সুরা রাদ ২২-২৪)
ধৈর্যের পরীক্ষা : মানবজীবনে সুখ ও দুঃখ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোরআনের ভাষ্যমতে মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়। এমনকি যুগে যুগে মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনকারী নবী-রাসুলরাও কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে তারা ধৈর্যের সুউচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পবিত্র কোরআনে ধৈর্যধারণকারীর জন্য সুসংবাদ এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কিছুটা ভয়ভীতি, ক্ষুধা, জানমাল ও ফল-ফসল ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করব। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। যাদের ওপর কোনো বিপদ আপতিত হলে তারা বলে, আমরা তো আল্লাহরই জন্য এবং আমরা নিশ্চিতভাবে তার কাছেই ফিরে যাব। এসব লোকের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়। আর এরাই সৎপথে পরিচালিত।’ (সুরা বাকারা ১৫৫-১৫৭) অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! নিশ্চয় তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের নিজ জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে।’ (সুরা আলে ইমরান/১৮৬) সর্বোপরি আপনার দুঃখ-যন্ত্রণা যে পরীক্ষার কারণ হতে পারে, তাও স্মরণ রাখতে হবে। কেননা পরীক্ষায় আপনাকে অবশ্যই সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে হবে। তবেই পরিত্রাণ পাবেন।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তি মানসিক বা শারীরিক কষ্ট পেলে, কোনো শোক বা দুঃখ পেলে অথবা চিন্তাগ্রস্ত হলে সে যদি ধৈর্যধারণ করে তাহলে আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দেন। এমনকি চলতি পথে যদি সামান্য একটি কাঁটাও তার পায়ে ফুটে তার বিনিময়েও গুনাহ মাফ করা হয়।’
(সহিহ বুখারি)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন নর-নারীর ওপর সময় সময় বিপদাপদ পরীক্ষাস্বরূপ এসে থাকে। কখনো সরাসরি তার ওপর বিপদ আসে, কখনো তার সন্তান মারা যায়, কখনো তার ধন-সম্পদ বিনষ্ট হয়। আর সে এসব মুসিবতে ধৈর্যধারণ করার ফলে তার কলব পরিষ্কার হতে থাকে এবং পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে থাকে। অবশেষে সে নিষ্পাপ আমলনামা নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হয়।’ (তিরমিজি)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি তার পবিত্র জীবনে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আইয়ুব (আ.) কঠিন ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার শরীর থেকে মাংস খসে পড়েছিল, তখনো তিনি ধৈর্য না হারিয়ে মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা রেখে পরম সাফল্য লাভ করেছিলেন।
ধৈর্যশীলতা অর্জনের উপায় : ধৈর্যশীলতা একটি কল্যাণকর গুণ। এটি অর্জন করতে মানুষের মধ্যে দৃঢ়তা ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। এজন্য বিপদ-আপদে ও দুঃখ-কষ্টে প্রথম অবস্থাতেই ধৈর্যধারণ করতে হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ধৈর্য হলো বিপদের প্রথম মুহূর্ত।’ (সহিহ বুখারি) তাই যে কোনো বিপদ-আপদে বিচলিত না হয়ে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে বিপদ উত্তরণের জন্য সাহায্য চাইতে হবে। তাছাড়া আপতিত বিপদে নিজের কষ্টের ব্যাপারে কোনো মাখলুকের কাছে কোনোরূপ অভিযোগ করা উচিত নয়। আর এর বিনিময়ে একজন মুমিন বান্দা আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে লাভ করবেন অজস্র নেয়ামত ও অফুরন্ত অনুগ্রহ।
ধৈর্য এমন এক মহৎ গুণ, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও কল্যাণকর জীবনযাপনের জন্য ধৈর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করব, তাহলেই আমাদের জীবন হবে সুন্দর ও সার্থক।
ভয়েস/আআ