বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৫১ পূর্বাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
আত্মসমালোচনা হলো নিজের ভালো-মন্দ কাজের জন্য নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করা। মন্দ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং সে কাজটি পরিত্যাগ করে ভবিষ্যতে তা না করার অঙ্গীকার করা। আর ভালো কাজের জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং তা আগামীতে অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এ প্রসঙ্গে আল্লামা মাওয়ারদি (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষ রাতের কোনো এক সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। যদি সেগুলো ভালো ও প্রশংসনীয় হয় তাহলে, তা যথারীতি বহাল রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ সামনে এলে তা করে যাবে। আর যদি তার কাজগুলো নিন্দনীয় হয়, তাহলে অনুশোচনা করা, লজ্জিত হওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কোনোভাবেই এসব কাজ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করা।’ (আদাবুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দিন ৪৫৩-৪৫৪)
আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষ-ত্রুটিগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং তা সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘আত্মসমালোচনার অর্থ হলো, নিজের করণীয় ও বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। অতঃপর সর্বদা ফরজ ও নফল কর্তব্যগুলো আদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং হারাম বিষয়গুলো পরিত্যাগ করার ওপর সুদৃঢ় থাকা। তিনি আরও বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হলো, প্রতিটি কাজে সর্বপ্রথম আল্লাহর হকগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। অতঃপর সেই হকগুলো যথাযথভাবে আদায় করা হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখা।’ (আল-ফাওয়ায়েদ)
আত্মসমালোচনার গুরুত্ব : আত্মসমালোচনা প্রত্যেক মুমিনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। আত্মসমালোচনার প্রতি উৎসাহিত করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আগামীকালের জন্য (আখেরাতের জন্য) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা পাপাচারী।’ (সুরা হাশর ১৮-১৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা কর্তব্য যে, আখেরাতের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, নাকি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?’ (মাদারিজুস সালেকিন ১/১৮৭)
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা আত্মসমালোচনাকারীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কুমন্ত্রণা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়।’ (সুরা আরাফ ২০১)
হাদিস থেকেও আত্মসমালোচনার ধারণা পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের সমালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে চলে এবং আল্লাহর কাছে বড় বড় আশা পোষণ করে।’ (সুনানে তিরমিজি)
আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ওমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা ওজন করে নাও চূড়ান্ত দিনে ওজন নেওয়ার আগেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদের সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কোনো কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।’ (তিরমিজি)
অনুরূপভাবে হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করে, কেয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের আমলের হিসাব সহজ হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, কেয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে।’ (আয-যুহদ ৩০৮)
আত্মসমালোচনায় কড়াকড়ি : কৃপণ ও লোভী অংশীদার যেমন তার অন্য অংশীদারদের থেকে নিজের পাওনা কড়ায়-গ-ায় বুঝে নেয়, তেমন করে মানুষ নিজের মনের কাছ থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে না নেওয়া পর্যন্ত সে মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। মায়মুন ইবনে মিহরান (রহ.) বলেছেন, ‘অংশীদার থেকে নিজের পাওনা বুঝে নিতে মানুষ যত না কঠিন প্রাণ হয়, নিজের মন থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে নিতে তার থেকেও বেশি কঠিন মনস্ক না হওয়া পর্যন্ত সে মুত্তাকি হতে পারবে না। এমনকি সে খুব ভালোভাবে জেনে নেবে, তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আয়-রোজগার কোথা থেকে আসে? এগুলো কি হালাল উৎস থেকে আসে, না হারাম উৎস থেকে?’ (আবু নুআইম, হিলয়াতুল আউলিয়া ৪/৮৯)
সুতরাং আত্মসমালোচনায় কড়াকড়ি করলে সেই আত্মসমালোচনা থেকে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আত্মসমালোচনায় গা ছাড়া ভাব দেখালে তা কোনো আত্মসমালোচনাই হবে না।
আত্মসমালোচনার বিষয়ে উদাসীন না হওয়া : আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াসী মুমিনের একান্ত কর্তব্য হলো, আত্মসমালোচনা থেকে কখনোই গাফেল না হওয়া এবং নিজের আত্মার প্রতি কঠোরতা করার ব্যাপারে উদাসীন না থাকা। বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের ওপর শরিয়ত আরোপিত বাধ্যবাধকতা ও বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। একজন মুসলমানকে জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসই মহামূল্যবান হীরা-জহরত মনে করতে হবে। এগুলো এত মূল্যবান সম্পদ যে, পরকালের চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা কেবল এই সম্পদ দ্বারাই ক্রয় করা সম্ভব। সুতরাং এই মহামূল্যবান সম্পদ অপচয় ও নষ্ট করা কিংবা এর দ্বারা এমন বস্তু ক্রয় করা, যা ক্ষণস্থায়ী কিংবা তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে, সেটি হবে চরম মূর্খতা। এমন মূর্খতা যে, একমাত্র সীমাহীন নির্বোধ, চরম মূর্খ ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তি ছাড়া আর কারও দ্বারা এরূপ কাজ সংঘটিত হতেই পারে না। এই সীমাহীন মূর্খতার দুঃখবহ ক্ষতির বহিঃপ্রকাশ ঘটবে সেই দিবসে, যেই দিবসকে আফসোস ও আক্ষেপের দিন বলে অভিহিত করা হয়। এদিন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘এই দিন প্রত্যেকে সে যে ভালো কাজ করেছে এবং যে মন্দ কাজ করেছে তা বিদ্যমান পাবে। সেদিন সে নিজে এবং তার খারাপ কর্মফলের মাঝে দূরবর্তী ব্যবধান কামনা করবে। আল্লাহ তার নিজের সম্বন্ধে তোমাদের সাবধান করেছেন। আল্লাহ বান্দার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল।’ (সুরা আলে ইমরান ৩০)
পরকালে উত্থাপিত প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা : রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোনো মানুষ এক কদমও নড়তে পারবে না। এক. সে তার জীবনকাল কোন কাজে অতিবাহিত করেছে? দুই. যৌবনের শক্তি-সামর্থ্য কোথায় ব্যয় করেছে? তিন. ধন-সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে? চার. অর্জিত ধন-সম্পদ কী কাজে ব্যয় করেছে? পাঁচ. সে দ্বীনের কতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (সুনানে তিরমিজি)
কেয়ামতের দিন উপরোল্লিখিত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার চিন্তা বান্দাকে তার মনের হিসাব গ্রহণে তৎপর করতে পারে। এতে করে সে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করবে, সত্যের অনুসরণ করবে, বাজে কাজে সময় ব্যয় ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ ত্যাগ করবে এবং ফরজ পালন, হারাম ত্যাগ ও নফল-মুস্তাহাব বেশি বেশি আদায় করবে। আর মাকরুহ ও সন্দেহ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বদ্ধ পরিকর হবে।
বান্দাকে কেয়ামত দিবসে তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার কান, চোখ ও বিবেক প্রতিটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)
সর্বোপরি আত্মসমালোচনা মানুষের আত্মসংশোধনের পথকে সুগম করে। ফলে যেকোনো মানুষ তার ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার কল্যাণময় পাথেয় লাভ করে। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে আত্মসমালোচনা করার তওফিক দান করুন।
ভয়েস/আআ