বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৩০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।
শিরোনাম :
খালেদা জিয়াকে চৌদ্দগ্রামে নাশকতা মামলা থেকে অব্যাহতি ১৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে ভারত বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একসাথে কাজ করবে ফলাফল জালিয়াতি:চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব নারায়ন চন্দ্র নাথসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা টেকনাফে পাচারকারীর ফেলে যাওয়া বস্তায় পাওয়া গেল সাড়ে ৪ লাখ পিস ইয়াবা পেকুয়ায় হরিণাফাঁড়ী এলাকায় টপসয়েল কাটা বন্ধে অভিযানে হামলাচেষ্টা ফারিনের ‘ঠিকানা’ ১০ মিলিয়নে বিশ্বকাপের দৌড়ে উইন্ডিজকে হারিয়ে টিকে থাকল বাংলাদেশ বাণিজ্যকে আমরা রাজনীতির সাথে মিলাচ্ছি না:খাদ্য উপদেষ্টা বেড়েছে চোরের উপদ্রব, আতঙ্কে দিন কাটে মানুষের

ইসলামি অর্থনীতির বিস্তৃত ধারণা

মাহবুবুর রহমান:
ইসলামি অর্থনীতি ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়। এই অর্থনীতি মানবজাতির পার্থিব ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করার উদ্দেশে গড়ে ওঠে। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে সম্পদ ব্য বস্থাপনা, উপার্জন, ব্যয় ও বিতরণের প্রতিটি দিক কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিয়ন্ত্রিত হয়।

আল্লাহর মালিকানা স্বীকার : ইসলামি অর্থনীতি বিশ্বাস করে যে, সব সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মানুষ কেবল এর তত্ত্বাবধায়ক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহর।’ (সুরা বাকারা ২৮৪)

ন্যায়বিচার ও সাম্যের ভিত্তি : ইসলামি অর্থনীতি এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে যেখানে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য বজায় থাকে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যাতে সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে।’ (সুরা হাশর ৭)

সুদমুক্ত অর্থনীতি : সুদ নিষিদ্ধ এবং তা সমাজে শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা ২৭৫)

জাকাত ও দান : দরিদ্র ও বঞ্চিতদের সাহায্যের জন্য ইসলামি অর্থনীতিতে জাকাত বাধ্যতামূলক। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো।’ (সুরা বাকারা ৪৩)

সম্পদের সুষম বণ্টন : সম্পদের অপচয় ও একত্রীকরণ নিষিদ্ধ, যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সুরা ইসরা ২৭)

ইসলামি অর্থনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র

ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থা : ইসলামি ব্যাংকিং সুদবিহীন আর্থিক লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা ও মুরাবাহা হলো ইসলামি ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি।

জাকাত ও সদকা : জাকাত হলো ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ, যা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এটি সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। সদকা স্বেচ্ছায় প্রদান করা হয়, যা দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক।

হালাল ব্যবসা ও বাণিজ্য : ইসলামি অর্থনীতিতে ব্যবসার জন্য হালাল পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রতারণা, মিথ্যাচার, ওজনে কম দেওয়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ।

ওয়াকফ (ধর্মীয় দান) : ওয়াকফ হলো সমাজের কল্যাণে দানকৃত সম্পদ, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনসেবায় ব্যবহৃত হয়। এটি দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

বীমা ব্যবস্থা (তাকাফুল) : ইসলামি বীমা ব্যবস্থায় ঝুঁকি ভাগাভাগি করা হয়। এটি সুদ ও গ্যারান্টি এড়িয়ে শরিয়াহভিত্তিক নিয়মে পরিচালিত হয়।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা : ইসলামি অর্থনীতিতে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়। অযথা সম্পদ অপচয় ও সম্পদের অসম বণ্টন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

কৃষি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা : ইসলামি অর্থনীতি কৃষি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ভূমি ব্যবহার, জলসেচ এবং কৃষি উৎপাদনে ন্যায়সঙ্গত নীতি অনুসরণ করা হয়।

শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার : শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান এবং মানবিক পরিবেশে কাজ নিশ্চিত করা হয়। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ইসলামি অর্থনীতির একটি প্রধান দিক।

ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্ব

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : ইসলামি অর্থনীতি সমাজে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা ন্যায়বিচারের সঙ্গে মাপ ও ওজন করো।’ (সুরা হুদ ৮৫)

দারিদ্র্য বিমোচন : জাকাত, সদকা ও ওয়াকফের মাধ্যমে দরিদ্রদের সাহায্য করা হয়। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গরিবের প্রতি দয়া করে, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি)

সুদমুক্ত অর্থনীতি : সুদের কারণে সমাজে শোষণ ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ইসলাম এই শোষণমুক্ত অর্থনীতি নিশ্চিত করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ (সুরা আলে ইমরান ১৩০)

নৈতিক ব্যবসা ও বাণিজ্য : ব্যবসায় সততা ও নৈতিকতা বজায় রাখা ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম শর্ত। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সৎ ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি)

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন : ইসলামি অর্থনীতির প্রতিটি দিক আল্লাহর নির্দেশ মেনে পরিচালিত হয়, যা মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা যা কিছু দান করো, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।’ (সুরা বাকারা ২৭২)

ইসলামি অর্থনীতি শুধু একটি আর্থিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার অংশ। এর মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ নিশ্চিত করা, আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং একটি ন্যায়বিচার ও নৈতিকতাভিত্তিক সমাজ গঠন করা। কোরআন ও হাদিসে এর গুরুত্ব বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতি সম্পর্কে আরও গভীরতর আলোচনা তুলে ধরা হলো।

সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ : ইসলামে মানুষকে সম্পদের মালিক বলা হলেও প্রকৃত মালিকানা আল্লাহর। মানুষ কেবল এই সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক। সম্পদের এই বিশ্বাস মানুষকে অহংকার ও লোভ থেকে বিরত রাখে এবং সমাজের কল্যাণে সম্পদ ব্যবহারে উৎসাহিত করে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা : ইসলামি অর্থনীতি সম্পদের এমন বণ্টন নিশ্চিত করে, যেখানে ধনী-গরিবের মধ্যে অসমতা কমে যায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি যদি নিজের জন্য যা ভালো মনে করো, তা অন্যের জন্য চাও, তবে সত্যিকারের মুমিন হবে।’ (সহিহ বুখারি)

আয়ের বৈধ উৎস ও হারাম নিষিদ্ধকরণ : ইসলামি অর্থনীতি বৈধ উপার্জন নিশ্চিত করে এবং হারাম (সুদ, জুয়া, প্রতারণা) উপার্জন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা নিসা ২৯) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হারাম উপার্জনের মাধ্যমে যে দেহ গঠিত হয়, সেটার জন্য জাহান্নাম উপযুক্ত।’ (তিরমিজি)

সুদমুক্ত আর্থিক লেনদেন : সুদ সম্পদকে কেন্দ্রীভূত করে এবং সমাজে শোষণ সৃষ্টি করে। ইসলাম এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতের দিন শয়তান স্পর্শকৃত পাগলের মতো উঠবে।’ (সুরা বাকারা ২৭৫) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী এবং এর সাক্ষী সবাই অভিশপ্ত।’ (সহিহ মুসলিম)

সমাজে দারিদ্র্য বিমোচন : ইসলামি অর্থনীতি জাকাত, সদকা ও ওয়াকফের মতো ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের জন্য একটি অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত ১৯) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গরিবদের প্রতি দয়া করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি)

ব্যবসা ও শ্রমের গুরুত্ব : ব্যবসা ও বৈধ পেশার মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকে ইসলাম অত্যন্ত উৎসাহিত করে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে থাকো। যাতে তোমরা সাফল্য লাভ করতে পার।’ (সুরা জুমুআ ১০) এখানে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করার কথা বলা হয়েছ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কর্মের মাধ্যমে উপার্জিত হালাল সম্পদই সর্বোত্তম।’ (সহিহ বুখারি)

সম্পদের সঞ্চয় ও অপচয় প্রতিরোধ : ইসলাম সম্পদ সঞ্চয়ের পাশাপাশি এর ব্যবহারেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। অপচয় ও কৃপণতা উভয়ই নিষিদ্ধ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মধ্যপন্থা অবলম্বন করলে দারিদ্র্য তোমাকে গ্রাস করবে না।’ (মুসনাদ আহমদ)

ইসলামি অর্থনীতি মানুষের জীবনকে ন্যায়পরায়ণ, নৈতিক ও কল্যাণকরভাবে গড়ে তোলার জন্য একটি সুষম ব্যবস্থা। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটি শুধু দুনিয়ার আর্থিক উন্নতি নয়, বরং আখেরাতের জন্যও প্রস্তুতির একটি মাধ্যম। ইসলামের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দারিদ্র্য, শোষণ ও বৈষম্য দূর হয়ে একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION