বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:২০ অপরাহ্ন
মাওলানা মনিরুজ্জামান:
ইতিহাসে এমন নিঃস্বার্থ অভিভাবকের দেখা মেলা ভার, যিনি নিজের জীবনের চেয়েও অনাগত অনুসারীদের মুক্তির চিন্তায় অধিক ব্যাকুল ছিলেন। তিনি হলেন মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আপন সুখ বিসর্জন দিয়ে উম্মতের যন্ত্রণাকে যিনি নিজের অস্তিত্বে ধারণ করেছিলেন, তার সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপ করা কোনো জাগতিক মানদণ্ডে সম্ভব নয়। পাপের সাগরে ডুবতে বসা মানুষকে জাহান্নামের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচাতে তার যে নীরব কান্না, সিজদাবনত আর্তনাদ, তা পৃথিবীর বুকে এক নজিরবিহীন অধ্যায় রচনা করেছে। প্রিয় নবীজির সেই সীমাহীন দরদ ও আত্মত্যাগের কিছু বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
নবীজি (সা.) সবসময় ছিলেন উম্মতের জন্য কল্যাণকামী। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে মানুষ) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন। তোমাদের যেকোনো কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সর্বদা তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবা ১২৮) কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আপনার ওপর কোরআন নাজিল করিনি।’ (সুরা তাহা ২)
উম্মতের হেদায়েত লাভের জন্য তার দরদ ও আত্মত্যাগের মাত্রা বুঝতে কোরআনে কারিমের এই আয়াতই যথেষ্ট। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সম্ভবত আপনি তাদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে স্বীয় প্রাণনাশ করে ফেলবেন, যদি তারা এই বাণীর প্রতি ইমান না আনে।’ (সুরা কাহাফ ৬) কোরআনের এই আয়াতগুলোতে উম্মতকে অতুলনীয় ভালোবাসার দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। বুকভরা আর্তনাদ, চোখভরা কান্না আর কান্নাভেজা কণ্ঠে দরদি নবী নবুয়ত লাভের পর থেকে মৃত্যু অবধি ‘উম্মাতি উম্মাতি’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন।
নবুয়ত লাভের শুরুর দিকে যখন মক্কার কাফেররা ইসলামের সত্য বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল তখন রাসুল (সা.) তায়েফবাসীর কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দরদভরে তাদের সফলতার পথে ডাকলেন। ওই অকৃতজ্ঞ হতভাগারা রাসুল (সা.)-এর ওপর চড়াও হয়ে পাথরের আঘাতে রক্তে জর্জরিত করল। আল্লাহর আরশে কাঁপন শুরু হলো। আল্লাহ ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতারা রাসুল (সা.)-কে সালাম দিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার কওম আপনাকে যা করেছে, তার সবই মহান আল্লাহ দেখেছেন। আমি হচ্ছি পর্বতমালার ফেরেশতা। আমার প্রভু আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আমাকে তাদের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেন। সুতরাং আপনি কী চান? আপনি চাইলে, আমি মক্কার বড় বড় পাহাড় দুটিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেব। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, (এমন কাজ করবেন না), আমি আশা করছি, মহান আল্লাহ তাদের থেকে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। (সহিহ বুখারি)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি যেন এখনো রাসুল (সা.)-কে নবীদের মধ্য থেকে এক নবীর ঘটনা বর্ণনা করতে দেখছি, তার সম্প্রদায় তাকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে, আর তিনি তার চেহারা থেকে রক্ত মুছছেন এবং বলছেন হে আল্লাহ! তুমি আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করে দাও। কেননা তারা অজ্ঞ। (সহিহ বুখারি)
উম্মতের প্রতি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কল্যাণকামিতা ও নিখাদ ভালোবাসা বেশ কিছু হাদিসে প্রকাশ পায়। এমনি একটি হাদিসে তিনি বলেছেন, আমার ও লোকদের উদাহরণ এমন যে, আগুন জ্বালানো হলো, যখন সেটার চারদিক আলোকিত হয়ে গেল, তখন পতঙ্গ ও ওই সব প্রাণী যেগুলো আগুনে পুড়ে, সেগুলো তাতে পুড়তে লাগল। তখন একজন সেগুলোকে আগুন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেগুলোকে আগুন পরাজিত করল এবং আগুনে পতিত হলো। তেমনি আমিও তোমাদের কোমর ধরে আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমরা তাতেই পতিত হচ্ছ। (সহিহ বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি নামাজে উম্মতের পাপমুক্তির দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতের আগে ও পরের এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব গুনাহ ক্ষমা করে দিন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)
আখেরাতের কঠিন মুহূর্তেও এ উম্মতের মুক্তির সুপারিশ করবেন রাসুল (সা.)। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক নবীকে এমন একটি বিশেষ দোয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা কবুল করা হবে। তারা (দুনিয়াতে) সে দোয়া করেছেন এবং তা কবুলও করা হয়েছে। আর আমি আমার দোয়া কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফায়াতের উদ্দেশে মুলতবি রেখেছি। (সহিহ মুসলিম)
ইমাম নববী (রহ.)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই হাদিসে উম্মতের প্রতি রাসুল (সা.)-এর পূর্ণ মায়া-মমতা ও দরদের কথা এবং তাদের কল্যাণসাধনে তার প্রচেষ্টার কথা ফুটে উঠেছে। তাই তো তিনি এই উম্মতের জন্য তার বিশেষ দোয়া তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তুলে রেখেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) একটি আয়াত পাঠ করলেন, যাতে ইব্রাহিম (আ.)-এর কথা উল্লেখ আছে, (তা হলো) ‘হে আমার রব! এসব প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত হবে।’ আর সেই আয়াতও পড়লেন যেখানে ঈসা (আ.)-এর কথা আছে, (তা হলো), ‘যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হেকমতও পরিপূর্ণ।’ অতঃপর রাসুল (সা.) দুই হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, হে জিবরাইল! মুহাম্মদ (সা.)-কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো সে কেন কাঁদছে? যদিও তোমার রবই ভালো জানেন। অতঃপর জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তা জিজ্ঞাসা করলেন। রাসুল (সা.) সব খুলে বললেন। যদিও আল্লাহতায়ালা সব জানেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালা বললেন, হে জিবরাইল! মুহাম্মদ (সা.)-কে গিয়ে বলো, আমি অচিরেই তোমার উম্মতের ব্যাপারে তোমাকে সন্তুষ্ট করব, ব্যথিত করব না। (সহিহ মুসলিম)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার ইচ্ছা হয় আমি আমার ভাইদের দেখব। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বললেন, তোমরা আমার সাহাবি। আমার ভাই তারাই, যারা আমাকে না দেখে আমার প্রতি ইমান আনবে। (মুসনাদে আহমাদ)
উবাই বিন কাব (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বনু গিফারের কুয়ার কাছে ছিলেন। এমন সময় তার কাছে জিবরাইল (আ.) আগমন করলেন এবং বললেন, আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে এক উপভাষায় কোরআন পড়ান। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা কামনা করি, আমার উম্মত এটার ক্ষমতা রাখবে না। তিনি দ্বিতীয়বার এসে বললেন, আল্লাহতায়ালা আপনাকে আদেশ করেছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে দুই উপভাষায় কোরআন পড়ান। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা কামনা করি, আমার উম্মত এটার ক্ষমতা রাখবে না। এভাবে তিনি একাধিকবার অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকেন, যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে সাত উপভাষায় কোরআন তেলাওয়াতের অনুমতি দেওয়া হয়। (ইবনে মাজাহ)
এসব বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, উম্মতের জন্য রাসুল (সা.)-এর কেমন ভালোবাসা ছিল। মহান আল্লাহ আমাদের রাসুল (সা.)-এর সত্যিকার উম্মত হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : খতিব ও মাদ্রাসাশিক্ষক
ভয়েস/আআ