বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৬ পূর্বাহ্ন
সাবিরা সুলতানা:
এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী ১২০ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেই কোনও না কোনোভাবে তাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী বা অন্য দেশের যুদ্ধের ফলে জীবন বাঁচাতে একটি নতুন দেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ১২০ মিলিয়ন মানুষ একটি ভিন্ন দেশে, নতুন পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতিতে এসে বিভিন্ন ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের এখন একটাই পরিচয়– তারা দেশহীন এবং শরণার্থী। বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক মানুষেরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
১২০ মিলিয়ন মানুষ! তিন অক্ষরের সংখ্যা। যাদের প্রত্যেকের একটি স্বপ্ন ছিল, একটি ভালোবাসায় ভরপুর পরিবার ছিল, প্রত্যেকের একটি গল্প ছিল। সেই গল্পটি কিন্তু এখন ভিন্নরকম। বাংলাদেশেও আছে প্রায় দশ লাখের মতো রোহিঙ্গা কমিউনিটি। যারা নিজের, পরিবারের এবং স্বজনদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা আছেন কক্সবাজারে ৩৩টি ক্যাম্পে। ক্যাম্পের অবস্থা খুবই মানবেতর। এই দশ লাখের বেশির ভাগই নারী, যুব এবং শিশু। কোনও কোনও শেল্টারে পাঁচ জনেরও অধিক মানুষ বসবাস করছেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিছু অল্প বয়স্ক নারীর সঙ্গে। যারা আইআরসি’র প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে গর্ভবতীকালীন সেবা নিতে এসেছিলেন। তাদের কথায় হতাশা ছিল। তারা জানেন না সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে। কতদিন ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। আদৌ নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কিনা? ক্যাম্পে বেশির ভাগ বিবাহিত নারী। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮০ শতাংশেরও বেশির ভাগ নারী সঙ্গীর দ্বারা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু বিচার পাওয়ার বা চাওয়ার প্রবণতা কম। ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। সেইসঙ্গে আছে পুরুষের ‘পলিগামিতা’। নারী ও শিশুরা পাচারেরও শিকার হচ্ছে।
একইসঙ্গে ক্যাম্পগুলোতে খাবার পানির স্বল্পতা রয়েছে। স্যানিটেশনের ব্যবস্থাও খুব স্বাস্থ্যকর নয়। একইসঙ্গে কক্সবাজারের ইকোসিস্টেম ধ্বংসের পথে। দশ লাখ রোহিঙ্গা কমিউনিটি ত্রাণ এবং খাদ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। রোহিঙ্গা কমিউনিটির যুবকদের শিক্ষার সুযোগ কম। তাদের কাজেরও সুযোগ নেই। সারা দিন তারা অলস সময় কাটায় এবং বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে জীবনযাপন করে চলেছে।
এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অনেক যুবক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে জড়িত আছে। কেউ ফটোগ্রাফি করছে, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত আছে। যা খুবই অনুপ্রেরণামূলক। নারী ও কিশোরীরা বিভিন্ন ক্রাফটের কাজ করছেন। তাদের এসব কাজে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। এই ক্রাফটগুলো জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমও হতে পারে।
সাত বছর ধরে রোহিঙ্গা কমিউনিটি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাস করছে। প্রতিটা দিন তাদের জন্য একটি অনিশ্চয়তার। হতাশা বাড়ছে, কিন্তু আশা আছে। প্রতিটি রোহিঙ্গা নারী, যুবক, বৃদ্ধসহ অন্যরা আশা করেন দ্রুত তারা তাদের দেশে ফেরত যাবেন। সেখানে তারা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাস করবেন।
দশ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দেওয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। নিজ দেশের নানান সীমাবদ্ধতার মাঝেও রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে আশ্রয় দেওয়া অনেক সাহসী এবং উদারতার বিষয়। ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করেছে রোহিঙ্গা কমিউনিটির সার্বিক ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশ্বনেতৃবৃন্দ ভুলতে বসেছেন। মিয়ানমারের যুদ্ধ চলছে। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা কমিউনিটির প্রত্যাবর্তন সম্ভব না। কিন্তু বিশ্বনেতাদের জোরালো ভূমিকা ও উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরি, যাতে মিয়ানমারসহ বিশ্বের সব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রোহিঙ্গা কমিউনিটিসহ সব শরণার্থী তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।
২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। শরণার্থী দিবসকে সামনে রেখে সবাই শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে পারেন। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন, যাতে তারা আশা জিইয়ে রাখতে সক্ষম হন; স্বপ্ন দেখতে পারেন। বিশ্বে যত শরণার্থী আছেন তারা যেন মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারেন।
লেখক: অ্যাডভোকেসি এবং কমিউনিকেশন প্রফেশনাল, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)।
ভয়েস/আআ/সূত্র: বাংলাট্রিবিউন।