শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

এক মাসের ক্লাস, পনের বছরের সিলেবাস

মোস্তফা কামাল:
১৫ বছর ৭ মাসের তুলনায় ৩০-৩১ দিন কোনো সময়ই নয়। কিন্তু, মানুষের চাহিদা-আকাক্সক্ষা অফুরান। দাবিও বিস্তর। হোক বন্যা-দুর্যোগসহ আরও নানান দুর্গতি। দাবিতে কোনো ছাড় নেই। নগদে সবার সব দাবি এখনই পূরণ করতে হবে। মানতে হবে। নইলে আদায় করে ছাড়া হবে। এ অবস্থা কারা করেছে, তা সবারই জানা। দাবিদাররা এতদিন কোথায় ছিলেন, কেন তারা দাবি নিয়ে এভাবে সোচ্চার হননি বা হতে পারেননি তাও জানার বাইরে নয়। ১৫ বছর ঘুমে নয়, সজাগই ছিলেন তারা। এখন মন ভরে আওয়াজ দিতে পারছেন। ১৫-১৬ বছর ধরে কথা বলার সাহস করেননি, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাচ্ছেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক। এটি এক ধরনের আকাক্সক্ষা।

অবস্থাটা এমন খুন-খারাবি, চুরি-পাচার করে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পারিষদ, এখন সে সবের দায় শোধের ভার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তার সরকারের। তার অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পার হয়েছে সোমবার। এক রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল ড. ইউনূসের সরকার। পর্বতসম দায়িত্ব এ সরকারের। তার সিলেবাস ও কাজের ভলিউম খুব মোটা। এ সিলেবাস শেষ করা এক মাসের কাজ নয়। এরপরও একটার পর একটা নয়, সমানে সব চ্যাপ্টারেই চোখ ফেলতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে করতে হচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থাও। গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করতে হয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সইও করেছে বাংলাদেশ। হবে-হচ্ছে করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে টাইপের কথা টানা ১৫ বছর শুনতে শুনতে মানুষের বমি করার দশা হয়েছে। কিন্তু, পেটের বমি মুখে আনার সুযোগও ছিল না। সেই অতিষ্ঠ মানুষ এখন নগদে কাজ দেখতে চায়। দেখতে চায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের দেখভাল সরকার ঠিকভাবে করছে কি না? এ আন্দোলনে যুক্ত হওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির সবাইকে ইউনূসের সরকার আমিরাতের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা আদায় করে দ্রুত দেশে ফেরাতে পারল কি না?

রাষ্ট্র মেরামতসহ নানা দাবি ও মানুষের উচ্চমাত্রার প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ জিততেই হবে সরকারকে। ষড়যন্ত্র, প্রতিবিপ্লবের অপচেষ্টা বা সময়কে দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের পথচলার মধ্যে সেই তেজ স্পষ্ট। হাল ছাড়া বা নেতিয়ে পড়ার নমুনা গত ৩১-৩২ দিনে দেখা যায়নি। মাত্র এক মাস সময় সামান্য হলেও সরকারের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। আর্থিক খাতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ যে কারও জন্যই বোধগম্য। বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে ব্যাংকগুলোকে মুক্ত করে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টির মালিকানা এস আলম গ্রুপের। সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালীদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের কাজও চলছে। নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন কার্যত বাতিল হয়ে গেছে।

বিচারিক ক্যু, আনসার বিদ্রোহের মতো অঘটন প্রতিহতের পাশাপাশি প্রশাসনে সংস্কার চলছে পুরোদমে। যদ্দুর সম্ভব পুলিশকে কাজে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ আপিল বিভাগ পুনর্গঠন করা হয়েছে দ্রুত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও পদত্যাগ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা এগোচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করানোর চেষ্টা রোখা হয়েছে। আবার এও জানানো হয়েছে, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোটের পুনর্বাসনের সুযোগ নেই।

গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২৯ আগস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন না। ১৩ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিনে সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সব উপজেলা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারই বাতিল, সংসদ বিলুপ্ত, সেখানে স্থানীয় সরকারগুলোকে ‘নাই’ করে দেওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। স্থানীয় সরকারের আইন ও বিধিবিধান মতেই করা হয়েছে এই বাতিল ও অপসারণের কাজটি। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেছেন, এটি স্থানীয় সরকার সংস্কারের অংশ। মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় প্রতিনিধিদের সেই প্রস্তুতি আগেই ছিল। নিজস্ব আমলনামা ও বেশিরভাগই বিগত সরকারের নেতা বা হোমড়া হওয়ায় তারা আগেই চম্পট দিয়েছেন। তারা এক এক জন কত ‘ভালো মানুষ’, কী তাদের জনভিত্তি, আর কীসব কাণ্ডকীর্তি, তা নিজেরা জানেন বলে কার আগে কে দৌড়ে পালাতে ফার্স্ট হবেন, সেই প্রতিযোগিতা ছিল।

প্রশাসনে বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর আবার নতুন করে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগও দেওয়া হয়। সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না। এদিকে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এরই মধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাধ্যমিকে আবারও ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা স্তরের স্থবিরতা কাটাতে ঢাকাসহ বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি বদল করা হয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান বদলও করা হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতাও সরকারের চোখ এড়ায়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনেও সংস্কারের ছোঁয়া পড়েছে। মাত্র এক মাসে এত কাজ কল্পনাশক্তিকে হার মানানোর মতো। অবশ্যই আরও অনেক কাজ এখনো বাকির খাতায়। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। শিল্পাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা ও বিভিন্ন জায়গায় নতুন চাঁদাবাজ গোষ্ঠী গজিয়েছে। পুলিশকে এখনো পুরোপুরি সক্রিয় করা যায়নি। থানা থেকে লুট হওয়া কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও তা সন্তোষজনক নয়। বিপুল অস্ত্র এভাবে বাইরে পড়ে থাকায় বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। শত শত প্রাণ বিসর্জনের পর এ পরিবর্তনে তাই জনগণের আকাক্সক্ষাও বিপুল। এই কাজের সূত্রপাতও এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। জনগণ দৃশ্যমান পরিবর্তন চায়। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারকে কিছু দৃঢ় ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতেই হবে। নইলে মানুষের ভরসায় ঘাটতি পড়বে। মানুষ সংস্কার সবদিকেই চায়। কোনটা আগে, কোনটা পরে তা নির্ণয়ের অবস্থা নেই। হলফ করে বলা যায়, যথাযথ সংস্কারে রাজনৈতিক কোনো দলই রাজি হবে না। যদি এমনটি করা হয় যে, এমপিরা কেবল আইন প্রণেতা হবেন। কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কর্ণধার হতে পারবেন না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হবে চার স্তরের স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে। আমলারা থাকবেন সেগুলোর সাচিবিক দায়িত্বে। আর সেগুলোর উপদেশক হবেন এলাকার সৎ ও যোগ্য লোকেরা। রাজি হবেন রাজনৈতিক দলের বড় নেতারা? আমলারাও? একটুও না। তারা রাজি হোন বা না হোন, অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকঠাকভাবে কাজটি করলে অন্তত এই সময়টায় বাধা দিতে পারবে না। এরই মধ্যে কথা উঠেছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মাঠে না থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে কাজ হচ্ছে না। মাঠে থাকলে যে তারা কী সব করেন, তা সবারই জানা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION