শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ পূর্বাহ্ন
শাহ্ মোহাম্মদ আরিফুল কাদের:
মানবতার নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের ওপর (তথা মুসলিম হয়ে) জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, নাসারা বা অগ্নিপূজারীরূপে গড়ে তোলে।’ (সহিহ বুখারি ১৩৫৯) মুসলিম হিসেবে এ বাণী গ্রহণ না করা মানে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া। আর ইসলাম থেকে দূরে সরে গেলে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়া মহান আল্লাহর সঙ্গে উপহাসের নামান্তর। যার ফলে পরকালীন শাস্তির পয়গাম তাদের প্রতি। কোরআনের ভাষায়, ‘(হে রাসুল) আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সঙ্গে, তার হুকুম আহকামের সঙ্গে এবং তার রাসুলের সঙ্গে ঠাট্টা করছিলে? ছলনা করো না, তোমরা যে কাফের হয়ে গিয়েছ ইমান প্রকাশ করার পর। তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেইও, অবশ্য কিছু লোককে আজাবও দেব। কারণ তারা ছিল গুনাহগার।’ (সুরা তাওবা ৬৫-৬৬)
সন্তান জন্মের পর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভালো কিংবা মন্দ কাজের ফলাফলের বদলা পিতা-মাতার ওপর বর্তায়। সে জন্য ছোট্ট থেকেই সন্তানকে ফিতরাতের (ইসলামের) কাজ করানো আবশ্যক। মায়ের কুল থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুসন্তান মৌখিক শিক্ষা, চালচলন ও কথাবার্তা শিখে পিতা-মাতার নিকট থেকে। বয়স পাঁচের ওপর হলে প্রতিষ্ঠানের জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষা গ্রহণের প্রাতিষ্ঠানিক ধরন চারটি। আলিয়া, কওমিয়া, ফুরকানিয়া ও স্কুল শিক্ষা। তন্মধ্যে প্রথম তিনটিতে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ফিতরাতের শিক্ষা (ইসলামি জ্ঞানের শিক্ষা) দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিতরাতের শিক্ষা (ইসলামি শিক্ষা) নামমাত্র প্রদান করা হয়। যা দ্বারা শিক্ষার্থীকে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলি পুরোপুরি শেখানো সম্ভবপর হয় না। ফলে তারা হরহামেশাই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কাজ করে।
অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। সম্প্রতি অর্জিত হয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। দেশের প্রতিটি পর্যায় মুক্ত-স্বাধীন হিসেবে গড়া হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। রাষ্ট্রীয় সব দপ্তরের কাঠামোয় যেমন সংস্কার করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক স্কুলগুলোতেও মঙ্গলজনক সংস্কার জরুরি। ধর্মের মৌলিক বিষয়াবলি যেন স্কুলের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া কাম্য। তাহলে হয়তো সামনের প্রজন্ম নৈতিকতার দিক থেকে আরও উন্নত হবে। নেশা, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, টেন্ডারবাজি ও মজুদদারিমুক্ত আলোকিত জাতির উদ্ভব হবে। কেননা ধর্মীয় জ্ঞান যার ভেতর থাকবে, সে সর্বদা আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেবে। লোকচক্ষুর আড়ালে অবৈধ কাজ করবে না। কারণ সে বিশ্বাস করবে মহান আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং পরকালে তার কাছে সবকিছুর জবাবদিহি করতে হবে।
বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। প্রতি বছর লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থী ভর্তি উপযোগী হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য। এপিএসসি শুমারি ২০২৩ অনুসারে কেবল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। বিপরীতে কিন্ডার গার্টেনে প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী বেড়েছে। উল্লিখিত তথ্য মোতাবেক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থী কমছে, বিপরীতে বাড়ছে কিন্ডার গার্টেন ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা। মাধ্যমিকের দিকে নজর দিলে আরও ভয়াবহ অবস্থা দেখা যায়। সারা দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের অধীন মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মোট ২০ হাজার ৩১৬টি। তার মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২ হাজার ৫৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৬ হাজার ৫১৬টি এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১ হাজার চারশ ৪৩টি।
দেশের এসব সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। মাত্র চার বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী কমেছে ১০ লাখের বেশি। এটিকে আশঙ্কাজনক বলছেন শিক্ষাবিদরা। অথচ একই সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে আড়াই লাখ। অবশ্য কারিগরি ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতেও শিক্ষার্থী বেড়েছে। যেখানে পাঁচ বছর আগেও এসব স্কুলে এ রকম অবস্থা দেখা যায়নি, সেখানে পাঁচ বছর পর এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হলো কেন? এর উত্তরে বলা যায়, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এক বক্তব্যে বলেন, সারা দেশে যত্রতত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়া কওমি-নুরানি মাদ্রাসার কারণে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে শিক্ষার্থী কমছে।
আমাদের মতো সাধারণ জনগণের প্রশ্ন, যদি যত্রতত্র নূরানি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার কারণে প্রাথমিকে এবং আলিয়া মাদ্রাসার কারণে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী কমে, তবে এর কারণ কী? যেখানে সরকারি সার্বিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী মোটা অঙ্কের টাকায় পড়াশোনা করছে মাদ্রাসায়। অভিভাবকদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, স্কুলে ধর্মীয় বই নামে যেসব বই প্রচলিত আছে তা দিয়ে কী করে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন হতে পারে? মুসলমান হিসেবে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মৃত্যুর পর আমাদের সন্তানরা আমাদের জানাজা দিয়ে দাফন করবে। স্বাভাবিকভাবে কোনটা হালাল কোনটা হারাম তা জানবে। যা স্কুলের ‘ইসলাম শিক্ষা’ বইয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে নেই। সুতরাং আমরা আমাদের সন্তানকে টাকা খরচ করে মাদ্রাসায় পড়াতে বাধ্য হই। মাদ্রাসায় পড়ালে তো অন্তত ইসলামের ওই কাজগুলো করে আমাদের হৃদয় শান্ত করবে।
সর্বশেষ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ফাজিল (স্নাতক) পাস সম্পন্ন করেছে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। অপরদিকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড হাইআতুল উলয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের সিলেবাসে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণদের মেধা যাচাই করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেমন ইসলামের আলোয় আলোকিত হবে, তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরও কর্মসংস্থান বাড়বে।
ভয়েস/আআ