সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১২:১৯ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

নির্বাচনের জাতীয়করণ লোয়ার থেকে হায়ারেও

মোস্তফা কামাল:
জাতীয়-স্থানীয়, পেশাজীবী আর পেশীজীবী। নির্বাচনের এক আজব ট্যাম্পো ধেয়ে ছুটছে সবখানেই। এর রুট পারমিট বা ফিটনেস কেবল অলিগলি নয়, রাজপথেও। দাবড়ানিতে দুমড়ে-মুচড়ে ধাবমান সবখানে। পরিস্থিতির অনিবার্যতার মতো এই আজব জার্নির সওয়ারিরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো কোনোটি কখনো কখনো জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও দামি হয়ে ওঠে। কোনো কোনো পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনেও তাই। এক সময় তা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনেও। সেই পর্বে অনেক দিন থেকে বন্ধ্যত্ব। না রাজনৈতিক দল, না ছাত্র সংগঠন, না শিক্ষক কোনো দিক থেকেই এ নিয়ে গরজ নেই। স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর মধ্যে কুমিল্লা ছিল বেশ আলোচিত। সেখানে যা হওয়ার তা স্বাভাবিকের মতোই হয়ে গেছে। সবই সম্ভব, সবই স্বাভাবিক। এ নিয়ে মাতবোলের আর অবকাশ নেই। স্থানীয় পর্যায়ে টুকটাক কিছু হলেও জাতীয় পর্যায়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন কুসিক আর ম্যাটার করে না। একই দিনে হয়েছে মসিক মানে ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনও। ইভিএম বিড়ম্বনার কারণে আলোচনার মাঠে এখনো টিকে আছে মসিক। তাও আরেক ইস্যুর তোড়ে হারিয়ে যেতে তেমন সময় লাগার কথা নয়। ততক্ষণে সামনে চলে আসবে অন্য কোনো ইস্যু বা ঘটনা। দেশে এখন প্রায় সব নির্বাচনই রাজনৈতিক। ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সব পেশাজীবীই রাজনীতিতে একাট্টা। তা এখন আর বাড়তি কোনো দোষগুণের বিষয় নয়। যদিও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর পত্তন হয়েছিল নিজস্ব পেশাগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। এ বাস্তবতায় তাদের ভিন্ন সম্প্রদায় ভাবার সুযোগ কমে এসেছে। সেই বিবেচনায় আলাদা সম্মান-সমীহ পর্বও দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে। জাতীয়তাবাদী ভ্যান-ঠেলা দল, আওয়ামী মৎস্য লীগ আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল বা সাংবাদিকদের সংগঠন প্রায় একই জাতভুক্ত। কে কী সেটা পরের বিষয়। আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি; পরে অন্য কিছু। সবার ক্ষেত্রেই, সদরঘাট-কমলাপুরের শ্রমিক-কুলি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

এবার কলঙ্ক বা হিম্মতের আরও মাত্রা যোগ হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ভোটে। বিতর্ক ও কলঙ্কের হ্যাটট্রিক সেখানে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট চলে দুদিন। পরে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ গভীর রাতে গণনা পর্বে কিল-কনুই মিলিয়ে সংঘর্ষ। একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্তত সাত আইনজীবী আহত। সেইসঙ্গে গালিগালাজ ও সম্বোধনের সে কী ভাষা লার্ডেনদের। নির্বাচনের ফল ঘিরে সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস কাজলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলাও বাদ যায়নি। পরদিন ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান সাইফ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। মামলায় ২০ জনের নাম উল্লেখসহ ৪০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে। আগের গভীর রাতে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির প্রধান অন্য কোনো প্রার্থী উপস্থিত না থাকায় সমিতির সম্পাদক পদে এক নারীপ্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ব্যালট বাক্সগুলো নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদ সুলতানা যুথী এবং বিএনপি সমর্থিত নীল প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন রাতেই ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। তবে এত রাতে প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকার কথা উল্লেখ করে সরকার সমর্থিত সাদা প্যানেলের সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহ মনজুরুল হকসহ কয়েকজন প্রার্থী শুক্রবার বাদ জুমা ভোট গণনার পক্ষে মত দেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ ও হট্টগোল হয়। এর ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে কয়েকজন বহিরাগত সমিতি মিলনায়তনে ঢুকে পড়েন। নির্বাচন পরিচালনা-সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ পুরো অবস্থার ভিডিও করতে থাকেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার ওপর চড়াও হন কয়েকজন আইনজীবী। সেই মারধরের ঘটনার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা চলাবস্থায় নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির প্রধান ভোট গণনা করতে চাইলেও সরকার সমর্থক প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী শাহ মনজুরুল হক শুক্রবার দিনের বেলায় ভোট গণনার পক্ষে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে বেশিরভাগ প্রার্থী ও তাদের এজেন্টরা চলে যান। এ সময় নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির প্রধান আবুল খায়ের নাহিদ সুলতানা যুথীকে সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করেন। পরে তিনিই আবার এ ঘোষণা বাতিল করেন। জানান সেটা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। গেলবারও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সরকার সমর্থক আইনজীবীদের একতরফা ভোট নিয়ে গণ্ডগোল পেকেছে। এবার সেখানে যোগ হয়েছে সংঘর্ষসহ অ্যাকশন-ড্রামা। তাও দিনে-রাতে সমানে। মেগা সিরিয়ালে।

দেশের ধনাঢ্য তৈরি পোশাকশিল্প মালিকরাও কি কম গেছেন? একই সময়ে হয়েছে তাদের সংগঠন বিজিএমইএর ২০২৪-২৬ সাল মেয়াদি নেতৃত্ব নির্বাচন। তারা ভোটের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। শনিবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে ভোট হয়। ঢাকায় ভোট শুরুর আগেই দুই প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যে এক পশলা হাতাহাতি। বিকালে ভোটকক্ষে আবারও বিশৃঙ্খলা। সকাল পৌনে ১০টার দিকে ভোটকেন্দ্রের নিচে প্রার্থীদের দাঁড়ানো নিয়ে সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরাম প্যানেলের নেতাদের মধ্যে বচসা হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতি। ফোরামের একজন প্রার্থী আহত। তবে, ব্যথা গুরুতর নয়। আঘাত একটু লাগলেও ইজ্জত যায়নি। মানির মান আল্লাহই রেখেছেন। নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলামিন সাংবাদিকদের বলেছেন, এ তেমন কিছু নয়। ভোট সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ছোটখাটো দুয়েকটি ঘটনা ঘটলেও বড় কোনো অভিযোগ আসেনি।

ভোট কেনাবেচা, প্রকাশ্য ভোটসহ জব্বর রাজনীতি সেখানেও। বিজিএমইএর এবারের নির্বাচনে ৩৫টি পরিচালক পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৭০ জন প্রার্থী। তারা সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরাম এই দুই প্যানেল থেকে নির্বাচন করেন। সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার বা দলনেতা এস এম মান্নান, যিনি বর্তমানে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। আর ফোরামের প্যানেল লিডার ফয়সাল সামাদ। তিনি সংগঠনটির সাবেক সহসভাপতি। এবারের ঘটনা নিয়ে ফোরামের প্যানেল লিডার ফয়সাল সামাদ গণমাধ্যমকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিজিএমইএর ইতিহাসে কখনো দেখেননি। মাছ বাজারের মতো অবস্থা।’ বিজিএমইএর এবারের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই উত্তাপ ছড়িয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ২ হাজার ৫৬৩ জনের প্রাথমিক ভোটার তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ৪২৯ জনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল বোর্ডে আবেদন করেন ফোরামের প্যানেল লিডার ফয়সাল সামাদ। তিনি অভিযোগ করেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের ওয়েবসাইট তল্লাশি করে দেখা গেছে, এই ভোটারদের আয়কর প্রদানের হালনাগাদ তথ্য নেই। পরে বিষয়টি নিয়ে আপিল বোর্ড শুনানি করে। তাতে ৬৭ জন ভোটার বাদ পড়েন। এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এফবিসিসিআই আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন ফয়সাল সামাদ। পরে তিনি উচ্চ আদালতেও যান।

মুখে নানান নীতিকথা আওড়ানো গেলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যবসায়ী-আইনজীবী, সাংবাদিক কাউকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের পরিচয়ও এখন দলের ভিত্তিতে। যে কারও ভিন্ন গুণমান ও পরিচয়ের জায়গাটা ক্ষীণ থেকে কেবলই ক্ষীণতর। তারা নিজেরা নিজেদের ক্রমশ আরও ছোট করে আনছেন। নিজেদের পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থরা রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরের গণতন্ত্র বা দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের তাগিদ দেওয়ার নৈতিক ক্ষমতা রাখেন না। জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন যেভাবে হোক, যেমনই হোক, প্রতীকে-ডামিতে যা হোক তা তাদের বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। সরকার বা রাজনৈতিক কোনো দলকে ছবক দেওয়ার মুখ নেই তাদের।

অন্যদিকে চলছে দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি। তাও ন্যায্য। ক্ষমতাসীন মহল এতে কোনো আইনি জটিলতা দেখছে না। নির্বাচন কমিশন-ইসিরও একই কথা। এতে আইনের ব্যত্যয় হবে না। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া, তথা কাউকেই দলের প্রতীক নৌকা বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আসে গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকে। একবারে জরুরি সে বৈঠকে বলা হয়- দলের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং যে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিতে পারবেন। এ সিদ্ধান্তের সময় ব্যাপক করতালি পড়েছে। ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকারের নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান চালু হয়। এরপর প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। দলের নেতাসহ এমপি-মন্ত্রীরাও বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। কোথাও কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের পক্ষে কাজ করা নেতাদের বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক শাস্তি দেওয়া হয়।

এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতেই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ঈগল-ট্রাক ইত্যাদি দিয়ে এ চর্চা হয়েছে। তাদের বিদ্রোহী নয়, ডামি বা স্বতন্ত্র নামে ডাকা হয়েছে। আসন্ন উপজেলায়ও হবে। বোঝাপড়া-সমঝোতাসহ ডামি-দামি নির্বাচনী কর্মযজ্ঞ পেশাজীবী সংগঠনগুলোতেও চলছে। ভালো হয়েছে। আরও হবে। স্থানীয়, পেশাগত বা নিজস্ব না বলে গুণ-বৈশিষ্ট্য বিচারে সেগুলোও এক একটি জাতীয় নির্বাচন।

লেখকঃ সাংবাদিক, কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION