শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০২:৫১ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

জলে জিম্মি স্থলে মুক্তি!

মোস্তফা কামাল:
দস্যুতা, জিম্মি করা, পণে মুক্তিসহ জলের কায়কারবার অনেকটা বিশেষায়িত। এসব জানেন-বোঝেন কেবল সংশ্লিষ্টরা। বরাবরের মতো এবারও তা-ই হয়েছে। সোমালিয়ার উপকূলে জিম্মি ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ৩২ দিন পর মুক্তির পরতে পরতেও একই উপাখ্যান। জলদস্যু-কবলিত নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর উদ্ধারের নেপথ্য খুঁটিনাটি জানেন জাহাজ মালিক, সরকার, দস্যু, উদ্ধার পাওয়া নাবিক আর মধ্যস্থতাকারীরা। জিম্মি নাবিকদের জাহাজে ছাগলের মাংস দিয়ে তেহারি খানাপিনা, নামাজ আদায়, ঈদ-নববর্ষ পালনের খবরাদি অন্যদের জন্য। হয়ে আসছে এভাবেই। সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জাহাজসহ নাবিক জিম্মি-মুক্তি-উদ্ধারসহ যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন এবারও সেভাবেই হয়েছে।

চ্যাপ্টারটি আপাতত শেষ। ক’দিন বাদে এমন আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত বিষয়টি আমরাও ভুলে থাকব। জলদস্যু মোকাবিলায় জাহাজগুলোতে কী ব্যবস্থা ছিল বা থাকে, কত পণে কোন রণে দফারফা হয়েছে তা সামনে আসবে না। মুক্তিপণের অঙ্ক সম্পর্কে মুখ না খোলাও একটি পণ বা শর্ত। এরা সবাই সবার জানাশোনা। নিজেরাই জলদস্যু নিজেরাই উদ্ধারকারী হওয়ার কাণ্ডকীর্তিও আছে। কেবল জলের দোষ নয়, স্থলেও কি ব্যতিক্রম? স্থলেও জলের জাহাজের মালিকপক্ষ এবং তদারকি সংস্থার মতো বাস-ট্রাকসহ পরিবহনকাণ্ড। বেশ মিল তাদের। উভয়ই ঠেকিয়ে ঠকায়। জ্বলে বা ভোগেন শুধু ভুক্তভোগী ও স্বজনরা। জাহাজি এ পেশা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কারও কারও মধ্যে এতে যুক্ত হওয়ার একটি ঝোঁক আছে। অবশ্য তারা বেশ লিমিটেড। তারা জানেন এ পেশায় নিরিবিলি অল্প সময়ে ভালো আয়-রোজগারের গোমড়। বিপদে পড়লে তখন বিশেষভাবে জ্বলতে হয় তাদের ও স্বজনদের। কেউ কেউ আবার বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এ জ্বলা ও জ্বালায়।

জিম্মি বা অপহরণ জলে হলেও মুক্তিসহ যাবতীয় দেনদরবার ও ফয়সালা স্থলেই হয়। বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের এই জাহাজ উদ্ধারে কীভাবে মুক্তিপণের অঙ্ক দস্যুদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তা নাবিকরা জাহাজের ডেকে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনই একজন নাবিক তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন, ছোট উড়োজাহাজ থেকে জাহাজের পাশে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। জাহাজের পাশে আগে থেকেই স্পিডবোটে করে অপেক্ষায় ছিল দস্যুরা। ডলারভর্তি ব্যাগ পানি থেকে সংগ্রহ করে দস্যুরা। এরপর প্রায় আট ঘণ্টা পর গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে যায়। আরেকজন নাবিকের বর্ণনা তুলে ধরে পরিবারের এক সদস্য গণমাধ্যমকে জানান, ডলারভর্তি ব্যাগ পানিতে ফেলার আগে নাবিকদের জাহাজের ডেকে নিয়ে এসে এক লাইনে দাঁড় করায় দস্যুরা। উড়োজাহাজ থেকে নাবিকদের প্রতি ইশারায় হাত তোলার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এরপর সব নাবিক হাত তোলেন। অর্থাৎ সব নাবিক জীবিত আছেন, এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই উড়োজাহাজ থেকে ডলার ফেলা হয়। তবে ব্যাগে কত ডলার ছিল, তা নিয়ে মালিকপক্ষ কোনো কিছু জানায়নি। মুক্তিপণের অর্থ পেয়েই দস্যুরা তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজ থেকে নেমে যায়নি। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের সময় জিম্মি জাহাজটির অদূরে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। আবার স্থলভাগে ছিল সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশের টহল।

১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটি জিম্মি করার পর সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূলের কাছে নিয়ে যায় দস্যুরা। ৯ দিনের মাথায় দস্যুরা প্রথম মুক্তিপণের দাবি জানায়। প্রায় দুই সপ্তাহ দর-কষাকষির পর মুক্তিপণের অঙ্ক চূড়ান্ত হয়। দস্যুরা নগদ ডলার ছাড়া নাবিকদের মুক্তি দেয় না। সে জন্য উড়োজাহাজে করে নগদ ডলার পৌঁছে দিতে হয় জিম্মি জাহাজের পাশে। আফ্রিকা অঞ্চলে এ রকম ছোট এয়ারক্রাফট পাওয়া যায়, যেগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়তে পারে। এর আগে ২০১০ সালে ছিনতাই হওয়া একই কোম্পানির জাহাজ এমভি জাহান মণি ১০০ দিনের মাথায় ছেড়ে দেয় দস্যুরা। তখনকার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিও এমনই ছিল।

বছর কয়েক ধরে একটু দমলেও সম্প্রতি নতুন করে চটেছে সোমালীয় জলদস্যুরা। তা অভাবের তাড়নায় না তাদের বনেদি পেশার প্রতি চেতনা জেগে ওঠায় তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে, লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অব এডেনে তারা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে বিশ্লেষণ কারও কারও। ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্য ভর করে দেশটিতে। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। ওই সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূলসমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না।

এতে এই অঞ্চলে বিদেশি মাছধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এতে অভাব অনটনে স্থানীয় জেলেরা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাছ ধরার চেয়ে দস্যুতায় আয়-রোজগারও ভালো। ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ব আফ্রিকার এ দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে সাড়ে তিনশো থেকে সোয়া চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন বলছে, সাগরে দস্যুতার কারণে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে সাত থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে দস্যুবৃত্তি। এখন আবার একটু চাগাড় দেওয়া।

সোমালিয়ার আশপাশের জলপথগুলো জাহাজ চলাচলের ব্যস্ততম নৌরুটগুলোর অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। প্রতি বছর আনুমানিক প্রায় ২০ হাজার নৌযান চলাচল করে সে সব পথে। আসবাব থেকে শুরু করে শস্য, জ্বালানি প্রায় সব ধরনের পণ্য পারাপার হয় এডেন উপসাগরের ওপর দিয়ে। সেখানে জলদস্যুদের ব্যাপক দৌরাত্ম্য চলেছে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১১ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল জলদস্যুদের আক্রমণ। সে বছর সোমালীয় জলদস্যুরা ২৩৭টি আক্রমণ চালিয়েছে। জিম্মি করেছে শত শত মানুষকে। পর্যবেক্ষক সংস্থা ওশেন বিয়ন্ড পাইরেসি ওই বছর হিসাব করে দেখেছিল যে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার গায়েব হয়ে গেছে। এ ছাড়া মুক্তিপণের পেছনেও কয়েকশো কোটি ডলার খরচ হয়েছে। সংগত কারণে সেই অঙ্কটি প্রদর্শনে আনা হয় না। স্বীকার করতেও সমস্যা। অর্থের সেই হিসাব আকাশে বা বায়ুতে মিলিয়ে দিতে হয়, অডিটে আনা যায় না। বলতে হয়, ভীষণ কষ্ট করে ব্যাপক মেধা-শ্রমে উদ্ধার করা হয়েছে জিম্মিদের। এ কৌশল বা চাতুরী সব দেশেই। আবার নদী-সাগরপথে ব্যাপক নিরাপত্তা দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সম্ভব নয় প্রতিটি জাহাজে নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন করা। আইনেও তা কাভার করে না। তাই জাহাজ মালিকরা নামকাওয়াস্তে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখে। কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে এ নিয়ে নানান কথা হয়। পরে আর খোঁজ থাকে না। তেমন তথ্য তালাশও হয় না।

বাংলাদেশের জাহাজগুলো মাঝেমধ্যেই বিপজ্জনক বা বেপথে চলাচল করে বলে অভিযোগ আছে। তা মনিটর হয় না। সেদিন এমভি আবদুল্লাহও ঝুঁকিপূর্ণ পথে এগোচ্ছিল। সোমালিয়াভিত্তিক আল-শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠী ডাকাতিতে উসকানি দিচ্ছে বলে এমন অভিযোগ আছে। জাহাজের স্টাফ ও জলদস্যুদের মধ্যে একটি কথিত সমঝোতার কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। যার বদৌলতে জঙ্গিরা দস্যুদের সুরক্ষা দেয়। আবার বিনিময়ে আদায়কৃত মুক্তিপণের একটি ভাগ পায় তারা। হাল বাস্তবতায় এদের মোকাবিলায় কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে।

বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনে একটি জাহাজ বিশ্বের যেকোনো বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। কোনো দেশের জলসীমা দিয়ে চলাচল করতে আলাদা অনুমতি নিতে হয় না। জাহাজ একটি বেসামরিক যান বলেই এমন বিবেচনা। আবার ওই জাহাজেই অস্ত্র বহন করলে সেটি আর বেসামরিক থাকে না। তখন এটি সামরিক নৌযান হিসেবে বিবেচিত। বিমানের ক্ষেত্রেও তাই। নৌজাহাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু একটি এলাকার জন্য নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করার ব্যবস্থা আছে। এতেও জটিলতা আছে। ব্যয়ও বেড়ে যায়। জাহাজের বেসামরিক বৈশিষ্ট্য না থাকায় তখন কোনো দেশ নিরাপত্তারক্ষী নামতে দিতে পারে না। ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ভাসমান নিরাপত্তারক্ষীদের ঘাঁটি তৈরি হয়। সেটি আরও ব্যয়বহুল। সুয়েজ থেকে এশিয়াগামী জাহাজগুলোতে নিরাপত্তারক্ষী ওঠে জেদ্দার অদূরে ভাসমান একটি জাহাজ থেকে। আবার তারা নেমে যায় ওমানের কাছের আরেকটি ভাসমান জাহাজে। এভাবে সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা হলেও তা ফলোদায়ক হয়নি। গোটা বাস্তবতাটাই ভিন্ন।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

mostofa71@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION