শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:১০ অপরাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে কেউ একা বাস করতে পারে না। সমাজের প্রত্যেক মানুষ একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে। সুখ-দুঃখ পরস্পর ভাগ করে নেয়। মানবিকতার দাবিতে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হয়। এভাবে একে অন্যের প্রয়োজনে বা উপকারে আসার নামই পরোপকার।
পরোপকার করলে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। পরোপকার মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের জন্য নির্দেশ দাও এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো। আর আল্লাহকে বিশ্বাস করো।’ (সুরা আলে ইমরান ১১০) শ্রেষ্ঠত্বের দাবি অনুযায়ী একজন মুসলমান অন্য মুসলমানকে শুধু নয়, সমাজের অন্য মানুষের বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে, এটিই ইসলামের শিক্ষা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (সহিহ্ বুখারি) তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অন্যের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার একশটি প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (সহিহ্ মুসলিম)
পরোপকার আদর্শ মানুষের একটি মহৎ গুণ। ইসলাম সহানুভূতির ধর্ম। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতা ইসলামের অন্যতম অনুষঙ্গ। সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। তাই পরোপকারের চেতনায় কোনো শ্রেণিভেদ নেই। ধনী-গরিব, ছোট-বড়, আত্মীয়-অনাত্মীয়, মুসলিম-অমুসলিম, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণ করা, উপকার করা আমাদের কর্তব্য। ইসলাম ও মানবতার সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুমিন মিলেমিশে থাকে। তার মধ্যে ভালো কিছু নেই, যে মিলেমিশে থাকতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ।’ (আল মুজামুল আওসাত) পরোপকারী লোকদের আল্লাহ অধিক ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সৎকাজ (ও পরোপকার করো), নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণ (ও পরোপকারী) লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা ১৯৫)
যারা মানুষকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ ইহসানকারী তথা পরোপকারীদের সঙ্গে থাকেন।’ (সুরা আনকাবুত ৬৯) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় কোনো মুমিনের একটি সমস্যার সমাধান করবে, আল্লাহতায়ালা আখেরাতে তার বিপদ থেকে একটি বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্তের অভাব মোচনে সাহায্য করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে স্বাচ্ছন্দ্য দান করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।’ (সহিহ্ মুসলিম)
তবে পরোপকার ও দান-সাদকা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করা উচিত, পার্থিব স্বার্থে নয়। কখনো এদিকে লক্ষ করা উচিত নয় যে, যার উপকার করা হয়েছে তার পক্ষ থেকে কী ধরনের আচরণ আসছে। তাই খোঁটা দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কেননা খোঁটা দিলে উপকার নিষ্ফল হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে তোমাদের দান-সাদকাকে বরবাদ করে দিয়ো না ওই ব্যক্তির মতো যে শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশেই দান করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না।’ (সুরা বাকারা ২৬৪) খোঁটা দ্বারা কেবল দান-সাদকা ও পরোপকারের সওয়াবই নষ্ট হয় না; বরং এটি একটি কঠিন পাপও বটে। কেননা এর দ্বারা উপকৃত ব্যক্তির অন্তরে আঘাত দেওয়া হয়। মানুষের মনে আঘাত দেওয়া কবিরা গুনাহ। সুতরাং খোঁটা দেওয়া ইমান ও ইসলামের চেতনা পরিপন্থী কাজ। ইসলামে পরোপকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি ইমানের দাবি এবং আল্লাহতায়ালার অত্যন্ত পছন্দের একটি আমল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না এবং যাকে দান করেছে তাকেও কোনো কষ্ট দেয় না। এর প্রতিদান তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। পরকালে তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা বাকারা ২৬২)
সমাজে নানা রকমের মানুষের বসবাস। আমাদের চারপাশে রয়েছে নানা পর্যায়ের মানুষ, তাদের জীবনে রয়েছে নানা সমস্যা। তাদের সেই সমস্যা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও পরোপকার। আর পরোপকারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে পরিবার থেকেই। শিশুদের পরোপকার করতে উৎসাহ দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরোপকারের সংস্কৃতি জোরদার করতে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। শিশুদের সামনে অন্যকে সহযোগিতা করলে তারা তা দেখে শেখে। দরিদ্রদের দান করার ক্ষেত্রেও শিশুদের সামনে এগিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
পরোপকারী হতে হলে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হতে হবে এমন নয়। প্রত্যেক মানুষই তার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পরোপকারী হতে পারেন। কেননা পরোপকার নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। বরং পরোপকার হতে পারে অনেক ধরনের। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্র ছাড়াও শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক কর্মকাণ্ডে এর পরিধি পরিব্যাপ্ত ও বিস্তৃত।
পরোপকার দ্বারা কেবল অন্যের কল্যাণ হয় তা নয়; বরং পরোপকারে নিজেরও কল্যাণ সাধিত হয়। কারণ পরোপকার করলে পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। যাদের উপকার করা হয় তারা
কৃতজ্ঞ হয়। যিনি উপকার করেন তিনি সওয়াবের পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি লাভ করেন। পরোপকার দ্বারা সহজে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। চরম শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়। এতে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা হয়। আর তখন সমাজ জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর।
ইসলাম এমন একটি জীবন-দর্শন, যার অন্যতম সৌন্দর্য হলো দান-সদকা, উদারতা ও মানবকল্যাণ। এটা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব, যিনি তার জীবনের প্রতিটি প্রয়োজন পূরণে প্রতিক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি তার সম্পদ শুধু নিজেই ব্যয় না করে তার সম্পদে অন্যদের যে অংশ আছে, সেটি প্রদানেও সচেষ্ট থাকবেন। আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত যেন সবাই মিলে উপভোগ করতে পারেন, তা তিনি নিশ্চিত করবেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান! তোমরা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করো। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এটাকে আটকে রেখো না, আটকে রাখাটা তোমার জন্য অকল্যাণ হয়ে দাঁড়াবে। প্রথমে তোমার পরিবার ও তোমার ওপর নির্ভরশীলদের জন্য ব্যয় করো। আর তারপর তাদের জন্য হাতটা উঁচু করো, যাদের হাত তোমাদের তুলনায় নিচে।’ (সহিহ্ মুসলিম)
ইসলাম সব সময় তার অনুসারীদের আল্লাহর রাস্তায় এবং অভাবীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। মানুষ দুনিয়াতে দানশীল ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করে এবং তার কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে। আল্লাহতায়ালা দানশীল ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। তাই তিনি দানশীল ব্যক্তিকে কেয়ামতের দিন চূড়ান্ত সাফল্য দান করবেন। তার কাজের প্রতিদান হিসেবে তাকে জান্নাত দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘দানশীল মানুষ আল্লাহর অতিশয় কাছে থাকেন, মানুষেরও নিকটবর্তী ও জান্নাতেরও কাছে থাকেন। জাহান্নাম তার থেকে দূরে থাকে।’ (জামে তিরমিজি)। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহতায়ালা দানশীলতার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! আমি তোমাদের যে জীবিকা দান করেছি, সেদিন (কেয়ামতের দিন) আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় করে নাও, যেদিন না থাকবে কোনো বেচাকেনা আর না কোনো সুপারিশ ও বন্ধুত্ব।’ (সুরা বাকারা ২৫৪)
দানের অপরিসীম সওয়াব ও ফজিলতের কথা শোনে আমরা অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনাথ, অসহায় ও বিপদগ্রস্ত লোকদের সহায়তা করি, তাদের প্রয়োজন পূরণে বিভিন্নভাবে দান-সদকা করি। আমাদের এসব দান-সদকা যদি হালাল ও বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ থেকে হয়, তাহলে মহান আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হবে। অন্যথায় এর কোনো প্রতিদান মিলবে না এবং কানাকড়িও মূল্যায়িত হবে না।
ভয়েস/আআ