বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৭ পূর্বাহ্ন
মুফতি শাব্বীর আহমদ:
হুজুরাত কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুরা। এই সুরার শুরুতে রাসুলের সঙ্গে মুমিনদের ব্যবহার কেমন হবে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে মুমিনদের পারস্পরিক আচার ব্যবহার ও সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ সুরায় মুসলমানদের এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা তাদের ইমানসুলভ স্বভাব-চরিত্র ও ভাবমূর্তির উপযুক্ত ও মানানসই। এখানে শুধু মুমিনদের পারস্পরিক আচার-ব্যবহার ও সামাজিক শিষ্টাচার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
সংবাদ গ্রহণ ও প্রচারে সতর্কতা : কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা আনয়ন করে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে দেখবে; যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত না করো এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’ (সুরা হুজুরাত ৬)
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি বর্ণনা করেছেন, তা হলো সংবাদ গ্রহণ ও বিশ্বাস এবং প্রচারে সতর্কতা। যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বড় গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক ব্যক্তি, শাসক বিশেষ করে সাংবাদিকদের উচিত যেকোনো সংবাদ গ্রহণ ও প্রচারের পূর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেওয়া। এর ফলে সমাজ থেকে ভ্রান্ত বিশ্বাস, মিথ্যা অপপ্রচার ও গুজবের দরজা বন্ধ হবে।
বিবাদ মীমাংসা করা : কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদের দুটি দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অতঃপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, যতক্ষণ না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ইনসাফ করো। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজুরাত ৯-১০)
এই আয়াত দুটি শান্তির সমাজ পরিচালনায় স্থায়ী মূলনীতি ও চিরন্তন দিকদর্শন সমতুল্য। কারণ সমাজবদ্ধ জীবনে পরস্পরে দ্বন্দ্ব হওয়াটা স্বাভাবিক। সব সমাজেই এটা আছে। কিন্তু তা অমীমাংসিতভাবে চলতে থাকলে সহিংসতা ও হানাহানির রূপ নেবে, যা বিরাট ক্ষতিকর। এই ক্ষতি শুধু বিবাদরতদেরই নয়, গোটা সমাজের। এতে সমাজের উন্নতি-অগ্রগতি ব্যাহত হয়। সামাজিক শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। তাই মহান আল্লাহ বিবাদ মীমাংসার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
উপহাস না করা : কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! পুরুষগণ যেন অপর পুরুষদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যাদের উপহাস করা হচ্ছে) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীগণও যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। তারা (অর্থাৎ যে নারীদের উপহাস করা হচ্ছে) তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ইমানের পর গুনাহের নাম যুক্ত হওয়া বড় খারাপ কথা। যারা এসব থেকে বিরত না হবে, তারাই জালেম। (সুরা হুজরাত ১১) এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষকে উপহাস, ঠাট্টা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করা। এটি ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহতায়ালা এটা অপচ্ছন্দ করেন। মানুষকে উপহাস ও বিদ্রুপ করা খুবই কুৎসিত কাজ এবং বড় গুনাহ। এতে মানুষের সম্মানহানি হয়, যা ঘোরতর অপরাধ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘সবচেয়ে বড় সুদ হলো অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের মানহানি করা।’ (আবু দাউদ)
মন্দ ধারণা ও ছিদ্রান্বেষণ না করা : কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম ধারণা ও অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারও গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না এবং তোমাদের একে অন্যের গিবত করবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কী তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা ঘৃণা করে থাকো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’
(সুরা হুজুরাত ১২)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ সর্বোচ্চভাবে একজন মুসলমানের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষার আদেশ দিয়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের প্রতি মন্দ ধারণা, গিবত-পরনিন্দা এবং ছিদ্রান্বেষণ থেকে বারণ করা হয়েছে। পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণা ও মহব্বতের সম্পর্ক রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে সব প্রকার সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এভাবেই কোরআনে মানুষের হৃদয় জগৎকে সব প্রকার অনুমান ও মন্দ ধারণা থেকে পবিত্র ও স্বচ্ছ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে এক মুসলিমের হৃদয়ে অন্য মুসলিমের জন্য মন্দ ধারণার পঙ্কিলতা না থাকে।
মন্দ ধারণা থেকেই হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। আর হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অন্যায়ের জন্ম। প্রমাণহীন মিথ্যা ধারণা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে ফেলে। অহেতুক মন্দ ধারণা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ধারণাভিত্তিক কথাই হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না এবং পরস্পর দুশমনি করো না। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (সহিহ বুখারি)
গিবত অর্থ পরনিন্দা। কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা। হতে পারে দোষটি তার মধ্যে আছে। কিন্তু এই আলোচিত দোষটির কথা শুনলে সে নির্ঘাত মনে ব্যথা পাবে। তাহলে এটাই গিবত। ইসলামের দৃষ্টিতে গিবত করা কবিরা গুনাহ। অন্যান্য কবিরা গুনাহের মতো গিবতও একটি হারাম কাজ। তবে অন্যান্য কবিরা গুনাহের সঙ্গে গিবতের পার্থক্য হচ্ছে, এটি হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হুকুকুল ইবাদ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ সম্পর্কে ইসলামের বিধান হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাফ না করা পর্যন্ত তা মাফ হবে না। অন্যান্য গুনাহ তওবার মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গিবতের বেলায় শুধু তওবা যথেষ্ট নয়। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরও ক্ষমা করে দিতে হবে। তাই অন্যান্য কবিরা গুনাহ থেকে গিবত করা নিঃসন্দেহে অন্যতম বড় গুনাহ।
বর্তমানে এ গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। ফিকহের দৃষ্টিতে গিবতের পরিধি অনেক ব্যাপক। অর্থাৎ কোনো মানুষের এমন কোনো বিষয়ের চর্চা করা, যা সে অপছন্দ করে, সেটি যে পর্যায়ের দোষই হোক না কেন। কোনো মানুষের শরীর, গঠন কাঠামো, মন-মস্তিষ্ক দ্বীনদারী, আখলাক-চরিত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, চলাফেরাসহ যেকোনো দোষের আলোচনাই গিবতের পর্যায়ভুক্ত। কোরআনের উপরোক্ত আয়াতে গিবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো মারাত্মক ও ঘৃণিত কর্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে।
আনাস ইবনে মালিক (রা.) ছিলেন রাসুল (সা.)-এর বিশিষ্ট খাদেম। সুদীর্ঘ দশ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, মিরাজের রাতে যখন আমাকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন (জাহান্নাম দেখানোর সময়) আমাকে এমন কিছু লোক দেখানো হয়েছিল, যারা নিজেদের নখের আঘাতে মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ থেকে রক্ত ঝরাচ্ছিল। আমি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা ওইসব লোক যারা মানুষের গোশত খেত অর্থাৎ গিবত করত। আর মানুষের ইজ্জত-সম্ভ্রমে আঘাত করত। (আবু দাউদ)
গিবত করাও হারাম এবং শোনাও হারাম। যে মজলিসে কারও গিবত করা হয় সেখানে যে ব্যক্তিই উপস্থিত থাকুক তাকে তা থেকে নিষেধ করা ওয়াজিব। যে ভাইয়ের গিবত করা হয় তার পক্ষ নিয়ে সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করাও আবশ্যক। সম্ভব হলে ওই মজলিসেই গিবতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মান-সম্ভ্রমের বিরুদ্ধে কৃত হামলাকে প্রতিহত করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার থেকে জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ) সমাজে কোরআনের এমন আদর্শ, শিক্ষা, আদব-শিষ্টাচার ও জীবনবোধের চর্চা হলে সর্বত্র বিরাজ করবে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সম্প্রীতি। গড়ে উঠবে সুন্দর সমাজ।
ভয়েস/আআ