শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ০৫:৪৯ পূর্বাহ্ন
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীন:
শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। অনেকগুলো সমাজ মিলে গঠিত হয় একটি রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র টিকে থাকে ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে। ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্রে সর্বদা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। আর জুলুম রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বিচারের ক্ষেত্রে ধনী-গরিব, নেতাকর্মী, সবল-দুর্বল পার্থক্য না করাই হলো ইনসাফ। কেবল ইসলামি রাষ্ট্র নয় বরং যেকোনো ধর্ম বা মতবাদের ওপর গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের জন্যই ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা জরুরি। ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজি (সা.)-কে বলেন, ‘হে নবী! আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা এই মর্মে দাবি করে চলেছে যে, তারা ইমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা আপনার ওপর নাজিল করা হয়েছে এবং সেসব কিতাবের প্রতি যেগুলো আপনার পূর্বে নাজিল করা হয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহ ফায়সালা করার জন্য ‘তাগুত’-এর দিকে ফিরতে চায়, অথচ ‘তাগুত’-কে অস্বীকার করার হুকুম দেওয়া হয়েছিল তাদের। শয়তান তাদের পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৬০)
মুফাসসিররা বলেন, এ আয়াতে ‘তাগুত’ বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে যিনি ইনসাফ বাদ দিয়ে জনগণের ওপর জুলুমের নীতি গ্রহণ করে নিয়েছেন। একইভাবে এমন সব বিচারক ও বিচারব্যবস্থাকে ‘তাগুত’ বলা হয় যেখানে জুলুমের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। কাজেই যে আদালত ইনসাফ অনুযায়ী বিচার করে না, সেই আদালত মানুষের প্রতি জুলুম করে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসুল (সা.) মদিনায় ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সন্তুষ্ট চিত্তে সেই বিচারব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কিছু নামধারী মুসলমান-মুনাফিক কোরআনের বিচারব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি। তারা মুখে দাবি করে, কোরআন মেনে নিয়েছি এবং পূর্ববর্তী সব আসমানি গ্রন্থে বিশ্বাস করি, কিন্তু নিজেদের মামলা-মোকাদ্দমা পরিচালনার জন্য এমন ব্যক্তি বা আদালতের কাছে যায় যেখানে ইনসাফ নয় বরং অর্থের জোরে রায় দেওয়া হয়। এমন আদালত ও বিচারককে কোরআনের ভাষায় ‘তাগুত’ বলা হয়েছে। আরবি ‘তাগুত’ শব্দটি এসেছে ‘তুগয়ান’ শব্দ থেকে। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) বলেছেন, ‘তাগুত’ শব্দটি কোরআনে পাঁচটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘তাগুত’-এর এক অর্থ সীমালংঘনকারী। এ আয়াতে ‘তাগুত’ বলতে বিভ্রান্ত, অবিবেচক ও মিথ্যা বিচারককে বোঝানো হয়েছে। যে বিচারক ঘুষ খেয়ে রায় বদলে দেয় সেই ‘তাগুত’। কেননা বিচারের যে সীমা ছিল সেটা তিনি লংঘন করে ফেলেছেন। ‘তাগুত’-এর দ্বিতীয় অর্থ শয়তান। সাহাবি হজরত ওমর (রা.), তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ.) ও মুফাসসির কাতাদা (রহ.) এমনটি বলেছেন। যেহেতু শয়তান মানুষকে সর্বশক্তি দিয়ে মহান আল্লাহর পথে আসতে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে চরম সীমালঙ্ঘন করে তাই শয়তান হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘তাগুত’। ‘তাগুত’-এর তৃতীয় অর্থ গণক। মুফাসসির ইবনে আবি হাতেম (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আবু বুরদা আসলামি নামে এক গণক ছিল। ইহুদিরা নিজেদের বিরোধ মেটানোর জন্য তার কাছে আসত। ইহুদিদের দেখাদেখি কয়েকজন নতুন মুসলমানও তার কাছে বিচারের জন্য যাওয়া-আসা করত। যেহেতু আবু বুরদা আসমালামি আসমানি কিতাব বিশ্বাস করত না, তাই ইনসাফ তার বিচারের নীতি ছিল না। ফলে মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচন করে মহান আল্লাহ সুরা নিসার ৬০ নম্বর আয়াত নাজিল করেছেন এবং ওই গণককে ‘তাগুত’ বলে উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে মাজহারি ৩/১৫৫)
মুফাসিসররা এ আয়াতের শানে নুজুল সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ ঘটনাটি বিশর নামক মুনাফিক সম্পর্কে। তার সঙ্গে এক ইহুদির জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ইহুদি বলল, ‘চলো! আমরা এ মোকদ্দমার ফায়সালা মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে নিই।’ মুনাফিক মনে মনে ভাবল, নবীজির ইনসাফের আদালতে গেলে নির্ঘাত ইহুদির পক্ষে রায় আসবে। কেননা এখানে ইহুদিই সঠিক। তাই নবীজির কাছে যাওয়া যাবে না। সে বলল, ‘মুহাম্মদ (সা.) নয়, বরং তোমাদের নেতা কাব বিন আশরাফের কাছে চলো।’ কাব বিন আশরাফ ছিল চরম ঘুষখোর। সে ঘুষ খেয়ে রায় বদলে দিত। ইহুদি বলল, ‘ঘটনা কী? আমি যেতে চাচ্ছি তোমাদের নবীর কাছে, আর তুমি চাচ্ছ আমাদের নেতার কাছে যেতে!’ অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা দুজন নবীজির কাছে গেলেন। নবীজি (সা.) তদন্ত শেষে যথারীতি ইনসাফভিত্তিক বিচার করে দিলেন এবং রায় গেল ইহুদির পক্ষে অর্থাৎ মুনাফিকের বিপক্ষে। এরপর ঘটনা আরও লম্বা। মুনাফিক নবীজির বিচার মানতে চাইল না। সে হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে গিয়ে আপিল করে। হজরত ওমর (রা.) নবীজির বিচার না মানার কারণে তাকে হত্যা করেন। ওমর (রা.) কর্র্তৃক তাকে হত্যা করার ঘটনাটি সনদের দিকে দিয়ে দুর্বল। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন ২/৪১৫-৪১৬)
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার। হজরত ওমর (রা.) কিন্তু ‘তাগুত’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ সাহাবি। তারপরও তার কাছে বিচার চাইতে যাওয়া ছিল ওই মুনাফিকের জন্য ভুল। কেননা প্রধান ব্যক্তি বিচার করে দেওয়ার পর সে বিচার অস্বীকার করে অন্য কারও কাছে বিচার চাওয়াও হারাম। তাই সুরা নিসারই অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের শপথ! যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিরোধ নিষ্পত্তির ভার তোমার ওপর না দেবে, তোমার সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীনভাবে সর্বান্তকরণে মেনে না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ইমানদার বলে গণ্য হবে না। (সুরা নিসা, আয়াত ৬৫) মহান আল্লাহ আমাদের বোঝার তওফিক দিন। আমিন।
ভয়েস/আআ