সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৬ অপরাহ্ন
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন:
গত ২২ অক্টোবর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আরও ৬ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের ঘটনার এক মাসের মধ্যে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটল। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিয়মিত বিরতির অন্যান্য হত্যাকান্ডগুলোকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের নেপথ্যে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র থাকলেও থাকতে পারে।
কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, রোহিঙ্গা শিবিরে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটাকে অনেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবে দেখা বা দেখানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু আমি সেটা মনে করি না। কেননা, আমার অভিজ্ঞতা বলে রোহিঙ্গা শিবিরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে সেখানে কঠোর পরিশ্রম করছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর হত্যাকারীদের অনেককেই ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। তাছাড়া মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর ক্যাম্পে যে উত্তেজনা এবং আতঙ্ক তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটাও শিবিরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলে নিয়েছে। এরপর ক্যাম্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আবার গত ২২ তারিখ সংঘটিত হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে ১৪ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এসবই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় তৎপরতার ফসল। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকান্ডের ঘটনার ক্রমবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সেখানে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকে প্রজেক্ট করলে ঘটনার মূল উৎস, কারণ এবং পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমাদের চোখ দূরে সরে যাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে একের পর এক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটার পেছনে মূল কারণ কী? আমার দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার কাছে মনে হয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে এ হত্যাকান্ড সংঘটনের পেছনে প্রধানত চারটি কারণ রয়েছে। এসব কারণ আমি সংক্ষেপে একের পর এক উপস্থাপন করছি। প্রধান কারণ হচ্ছে বিবদমান বিভিন্ন দল এবং উপ-দলগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন নামে উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টা অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে বেশকিছু দল বা উপ-দল আছে যারা বিভিন্ন ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নানান দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতেরই একটা রূপ হচ্ছে এমন হত্যাকান্ড।
এ পর্যন্ত যেসব হত্যাকান্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে বিবদমান দলগুলোর অন্তঃকোন্দলের ফলেই। এক হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে গত চার বছরাধিককালে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নিজেদের অন্তঃকোন্দলে হত্যার শিকার হয়েছে প্রায় ১১৪ জন রোহিঙ্গা। ফলে, আধিপত্য বিস্তারই এসব হত্যাকান্ডের অন্যতম প্রধান কারণ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্য। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সীমান্তে নানান ধরনের অবৈধ বাণিজ্য চলে। এটা যে ২০১৭ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছে বিষয়টি সে রকম নয়। দীর্ঘকাল ধরে বার্মা-বাংলাদেশ সীমান্ত বিভিন্ন ধরনের অবৈধ চোরাকারবারি কাজকর্মের জন্য পরিচিত ছিল। তবে, ২০১৭ সালের পর যখন বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা (প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষাধিক) বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন থেকে এসব অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্যের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার পরিমাণ বাড়তে তাকে। ফলে, এসব অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে যে একটি অবৈধ অর্থনীতি চালু হয়েছে সেটার সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন দল-উপদলগুলোও ক্রমান্বয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। আর এসব অবৈধ বাণিজ্য ও অবৈধ অর্থনীতির ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে বিভিন্ন সময় দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকে। তারই আরেকটা প্রতিফল হচ্ছে শরণার্থী শিবিরের এসব হত্যাকান্ড।
নিয়মিতভাবে ঘটা এসব হত্যাকান্ডের পেছনে তৃতীয় কারণটি হচ্ছেনতুন করে তৈরি বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসে, তখন তাদের প্রধান এবং প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনোসাইড থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য একটা আশ্রয় গ্রহণ করা। কিন্তু বিগত চার বছরাধিক সময়ে তারা মোটামুটি ভালোভাবেই আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাই, এখন তাদের জীবনে নতুন নতুন অনেক ইস্যু এসে হাজির হয়েছে যেমন: মিয়ানমারের রাখাইনে প্রত্যাবাসন, কিংবা ভাসানচরে স্থানান্তর প্রভৃতি।
এছাড়াও ২০১৭ সালের আগে যারা এখানে এসেছে এবং ২০১৭ সালের পরে যারা এসেছে তাদের মধ্যকার অধিকার, দায়িত্ব, কর্তৃত্ব এবং মালিকানার দ্বন্দ্বও মাঝেমধ্যে সংবাদের শিরোনাম হয়। আবার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে নানান ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েও অনেকের মধ্যে নানান ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্বও লক্ষ করা যায়। এরকম বিভিন্ন ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট মাঝেমধ্যে বড় আকার ধারণ করে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটে।
চতুর্থ কারণটি হচ্ছে রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকদের ক্রমবর্ধমান হতাশা। কেননা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশি সাহায্য সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের নিয়মিতভাবে খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধের জোগান দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিও চালু করেছে। যেমন শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। নারীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘হাতের কাজ’ শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি, নারীস্বাস্থ্যের সুরক্ষা, মাতৃকালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পুষ্টি-অপুষ্টি জ্ঞান প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু, রোহিঙ্গা তরুণ এবং যুবকদের জন্য তেমন দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ফলে, রোহিঙ্গা তরুণ এবং যুবকরা কেবল তিনবেলা খেয়ে বসে বসে দিন কাটাবে, এটা অস্বাভাবিক।
এসব কারণে তাদের মধ্যে বিদ্যমান হতাশা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কারণ তারা দেখছে, বাংলাদেশ তাদের রাখবে না, আবার মিয়ানমার তাদের নেবে না। তারা কোথায় যাবে? তাদের গোটা জীবনটাই সামনে পড়ে আছে। ফলে, তাদের মধ্যে জীবনের অনিশ্চয়তা এক ধরনের হতাশা তৈরি করছে। আর এসব হতাশা থেকেই রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকদের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে, অবৈধ কার্যক্রমে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছে।
এজন্যই বিগত চার বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক আর বর্তমানে জেলে আছে প্রায় ২ হাজার ৬৮৭ জন রোহিঙ্গা। এ সংখ্যাই বলে দেয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান অপরাধের প্রবণতা। আর এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেরই একটি ফল হচ্ছে বিভিন্ন সময় সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনা।
অতএব, কেবল সনাতন নিরাপত্তার ধারণা দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে হতাহতের ঘটনা আদৌ হ্রাস করা যাবে কি না, সেটা নতুন করে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যে কোনো ঘটনাকে যথাযথভাবে বুঝতে ‘টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচের’ (ওপর থেকে দেখা) পরিবর্তে ‘বটম-আপ অ্যাপ্রোচের’ (নিচ থেকে দেখা) প্রয়োগ বেশ কার্যকর ও ফলদায়ক হয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে হত্যাকান্ডের কারণ উপলব্ধি করতে হলে, ‘বটম-আপ’ এপ্রোচ জরুরি।
লেখক নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়