সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪১ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা

নিতাই চন্দ্র রায়:

দীর্ঘ দুই বছরের করোনার কশাঘাতে বাংলাদেশে যেসব খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তার মধ্যে কৃষি অন্যতম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক পরিচালিত ‘কৃষি খাত ও সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার ওপর করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাত্র দেড় মাসে দেশের কৃষকদের ক্ষতি হয় ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এত অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। অংশীজনের সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ছাড়া হঠাৎ সরকার প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে। এতে জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে চরম জনদুর্ভোগ। সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে পরিবহন মালিক সমিতি ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে সারা দেশে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘটের কারণে সিএনজি ও অটোরিকশার ভাড়া দ্বিগুণ বেড়ে যায়। হুট করে এ ধরনের কর্মসূচিতে দূর-দূরান্তের অসহায় যাত্রীরা পড়ে মহাবিপদে। বিশেষ করে, গরিব নারী ও বয়স্ক মানুষ দুর্ভোগে পড়ে বেশি। স্বাভাবিক সময়ে ত্রিশাল থেকে ময়মনসিংহের বাসভাড়া ২০ টাকা হলেও গণপরিবহন বন্ধের সুযোগকে একশ্রেণির বিবেকবর্জিত সিএনজি ও অটোরিকশাচালক যাত্রীদের কাছ থেকে এক রকম জোর করেই আদায় করে ৪০ টাকা। ময়মনসিংহ থেকে ভালুকার ভাড়া ৪০ টাকা হলেও সেখানে আদায় করা হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এসব দেখেও যাত্রীসাধারণের সহায়তায় কোনো ভূমিকাই পালন করেনি। এতে মহাবিপদে পড়ে স্কুল-কলেজের গরিব ছাত্রছাত্রী, ক্ষুদ্র কৃষক, খেটে খাওয়া শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সংঘবদ্ধ সিএনজি ও অটোরিকশাচালকদের কাছে তারা বড় অসহায়। তাদের করার কিছু নেই। কোনো রাজনৈতিক দলও যাত্রী নির্যাতন বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লেও বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ আর লঞ্চের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শতকরা ৩৫ ভাগ। অনেকের মন্তব্য এটা পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য মালিক ও সরকারের পাতানো খেলা ছাড়া কিছু নয়। এতে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লাভ হবে, আয় বাড়বে, পরিবহন মালিকের পকেট ভারী হবে আর চরম ক্ষতির শিকার হবে অভাগা যাত্রীসাধারণ। গত সাত বছরে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা লাভ করেছে। এই সাত বছরের বেশির ভাগ সময়ে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে। অন্যদিকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তেলের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যায় বলা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে গত জুনে প্রতি লিটারে ৩ টাকা এবং অক্টোবরে ১৩ টাকা লোকসান হয় সরকারের।

করোনার মতো মহামারীর কারণে কৃষি, শিল্প, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্যে যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন প্রণোদনাসহ স্বল্প সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব। দাম বাড়ানো তো নয়ই; পেট্রল, ডিজেল ও বিদ্যুতের মতো উৎপাদন উপকরণের দাম কমানো ও ভর্তুকি দেওয়া উচিত, যাতে পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হয় এবং দ্রব্যমূল্য থাকে স্থিতিশীল। করোনার পর এমনিতেই নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপর ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আবার বৃদ্ধি পেলে মহাবিপদে পড়বে দেশের কর্মহীন দরিদ্র জনগণ বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।

ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন ভাড়া বাড়বে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে পণ্যের দামের ওপর। পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল, আটা, ময়দা, লবণ, শাকসবজি, তেলসহ, প্রতিটি জিনিসের দাম আবার বাড়বে। এতে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। সরকারের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের স্লোগান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ দেশের অধিকাংশ ট্রাকে জ্বালানি হিসেবে ডিজেলই ব্যবহৃত হয়। আর সে সুযোগটা সিএনজিচালিত ট্রাক মালিকরাও অপব্যবহারে কুণ্ঠিত হবেন না।

বর্তমানে সারা দেশে চলছে আমন ধান কাটার উৎসব। আমন ধান কাটার পর ওই জমিতে কৃষক রবিশস্য লাগাবেন। কেউ কেউ রবিশস্য তুলে করবেন বোরো ধানের চাষ। আগাম জাতের বোরো ধানের চারা তৈরির কাজও চলছে এখন। কিছুদিন পরেই শুরু হবে বোরো ধানের চারা রোপণের ধুম। বোরো ধান শতভাগ সেচনির্ভর। সেচযন্ত্রের প্রধান জ্বালানি হলো ডিজেল। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জ্বালানির ৯৯ দশমিক ৭৩ শতাংশই ডিজেল। আর এই ডিজেলের দাম বাড়ানো মানে বোরোর উপাদান খরচ বৃদ্ধি করে কৃষককে তার ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সংঘবদ্ধ পরিবহন মালিক সমিতি বাসভাড়া বাড়িয়ে বহু গুণ লাভবান হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন সাধারণ যাত্রী, ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তা-সাধারণ। ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধিতে এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ বাবদ বাড়তি খরচ হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ হিসাব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। গবেষণা ইনস্টিটিউটের কথা বিঘাপ্রতি সেচের জন্য বাড়তি ৩০০ টাকা খরচের কারণে ধান বিক্রিতে প্রায় শতকরা ৩ ভাগ মুনাফা কমবে কৃষকের। ধানের উৎপাদন খরচ প্রতি বছরই বাড়ছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কৃষককে সার কিনতে হয়। বর্তমানে ২২ টাকা কেজির টিএসপি, ১৫ টাকার কেজির এমওপি ও ১৬ টাকা কেজির ডিএপি সার বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ২৫, ১৮ ও ২০ টাকা দরে। উপজেলা, জেলাপর্যায়ে সার ও বীজ মনিটরিং কমিটি থাকলেও তাদের কর্মকান্ড মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।

সরকারি হিসাবে, গত মৌসুমে বোরো ধানের কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে ২৭ টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে কৃষক এই ধান ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

দেশে ধান ছাড়াও কৃষির অন্যান্য খাতে সেচের প্রয়োজন হয়। শীতকালীন শাকসবজি, আলু, গম, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, আখের আবাদ, পুকুর ও ঘেরে মাছ চাষে সেচযন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। সারা দেশে প্রায় ১৬ লাখ ডিজেলচালিত ক্ষুদ্র (অগভীর নলকূপ) সেচযন্ত্র রয়েছে। জমি চাষ, ফসল কাটা, মাড়াই, পরিবহন, নৌযান চালানোর মতো কাজে সারা বছরই অগভীর নলকূপের ব্যবহার হয়। এসব কৃষিযন্ত্র ডিজেল দিয়েই চালাতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এ বছর ৪৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ জমির ৭০ শতাংশ বা ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হবে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্রে। সে হিসেবে কৃষকের বাড়তি খরচ গুনতে হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাকি ৩০ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হবে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রে। ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকের এমনিতেই উৎপাদন খরচ হয় বেশি, তারপর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এবার বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা কৃষকদের সঙ্গে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারকারীদের খরচের পার্থক্য আরও বেড়ে যাবে। সরকার সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর যে ভর্তুকি দেয়, তা থেকে লাভবান হন শুধু সেচযন্ত্রের মালিকরা। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যারা অন্যের অগভীর ও গভীর নলকূপ থকে সেচের পানি সংগ্রহ করেন, তারা সরকারি ভর্তুকির কোনো সুবিধাই পান না। আমাদের কথা, বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের মালিককে নয়; প্রকৃত বোরো ধানচাষিকে সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বোরো ধান রোপণ করা জমির পরিমাণ সঠিকভাবে জরিপ করে সেচের ওপর ভর্তুকি দিতে হবে। এতে ধানের উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও কমবে, পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়ে লাভবান হবেন প্রকৃত কৃষক।

গবেষকদের কথা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর একান্ত প্রয়োজন হলেও ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এতটা বাড়ানো কোনো অবস্থাতেই উচিত হয়নি। উচিত হয়নি করোনার আঘাতে জর্জরিত করুণ কৃষকের কষ্ট বাড়ানো। ধান বিজ্ঞানীরা বলছেন, বোরো ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে চাষ ও সেচ দিতে দরকার হয় ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বোরোর মুনাফা অনেক কমে যাবে। রবি মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বোরো ধান ছাড়াও গম, ভুট্টা, আলু, মিষ্টি আলু, ডাল, মসলা ও তেলবীজ, আখসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদিত হয়। বৃষ্টিবিহীন রবি মৌসুমে সেচ ছাড়া এসব ফসল উৎপাদন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। নদী, খাল-বিল ও সাগরে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত নৌকায় জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় ডিজেল। দেশে উৎপাদিত ধানের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো মৌসম থেকে। এ মৌসুমে ২ কোটি ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হোক, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ুক এটা মোটেই প্রত্যাশিত নয়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ২০০২-২১ অর্থবছরে কৃষিতে ব্যবহৃত যন্ত্রে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রাক্কলন করেছিল ১৯ লাখ ৩৯ হাজার টন। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে

কৃষিকাজে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। তবে বিশেষজ্ঞদের প্রত্যাশা, ফসল উৎপাদনে সেচ ব্যয়ের বিবেচনায় নিয়ে সরকার ডিজেলে কিছুটা ভর্তুকি বাড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে কৃষকের ওপর চাপ কিছুটা কমতে পারে। তাই প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রদান করে হলেও কৃষিকাজে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম প্রতি লিটারের বর্ধিত মূল্য থেকে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ টাকা কমানো উচিত। এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো অবকাশ নেই। সরকারকে অবশ্যই জনস্বার্থে বোরো মৌসুমের শুরুতে সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। কমাতে হবে ডিজেলের দাম। নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ পুষ্টিকর, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ধারাবাহিকতা।

লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন

netairoy18@yahoo.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION