সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:২৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

টিকটক ব্যবহারে সংযত হতে হবে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে বদলে গেছে অনেক কিছুই। জীবনযাপনেও এসেছে পরিবর্তন। দৈনন্দিন জীবনে এসেছে নানা উপকরণ। এই নতুন আবিষ্কার আমাদের যেমন সমৃদ্ধ করেছে; তেমনই বিব্রতও করছে। স্মার্টফোন, ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, মেসেঞ্জার, টুইটার, ইউটিউব, টিকটক, লাইকি, পাবজি আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর যেমন ইতিবাচক দিক আছে; তেমনই আছে নেতিবাচকতাও। সব উদ্ভাবনই মানুষের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। তবে তা গুটিকয়েক অসাধু লোকের কারণে ক্ষতির কারণও হয়ে উঠছে।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় টিকটকের কথা। টিকটক সব শ্রেণি-পেশার বা বয়সের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এটি ব্যবহারেও বিধিনিষেধ নেই। ফলে ঢালাওভাবে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। তাতেও অসুবিধা থাকার কথা নয়। অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায় টিকটকের কনটেন্টের মান নির্ণয় করতে গেলে। টিকটক কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজরও রাখে। অনেকের আইডি ব্যানড করা হয়। আপত্তিকর কনটেন্টও মুছে দেওয়া হয়। তার পরও ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’র মতো অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই থাকে। যে কারণে টিকটক ব্যবহারকারীকে সমাজ, পরিবার, স্বজনরা বাঁকা চোখে দেখেন। অথচ এটিও হতে পারত সুস্থ বিনোদনচর্চার শক্তিশালী মাধ্যম।

টিকটক মূলত ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করার অ্যাপ। বিশেষ করে তরুণদের কাছে। চীনের তৈরি অ্যাপটিতে মজার মজার নাচ ও ঠোঁট মেলানো হাস্যকৌতুকের ভিডিও তৈরি ও শেয়ার হয়। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী যেকোনো কিছুর সঙ্গে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে তা শেয়ার করতে পারেন। আবার এর সাহায্যে নিজের পছন্দের গানের সঙ্গে নাচ বা নানা ধরনের কমেডিও তৈরি করা যায়। তরুণ-তরুণীরা সিনেমার সংলাপ বা গানের সঙ্গে অভিনয় করে মজার মজার ভিডিও তৈরি করেন। একজন ব্যবহারকারীর যখন এক হাজারের বেশি ফলোয়ার হয়; তখন তিনি ভক্তদের জন্য লাইভে আসতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি ডিজিটাল উপহারও নিতে পারেন, যা অর্থের সঙ্গেও বিনিময় করা যায়। একজন ব্যবহারকারী যাকে অনুসরণ করেন, তিনি তার ভিডিও দেখতে পারেন। এ ছাড়া তিনি আগে যেসব বিষয়ে ভিডিও দেখেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে তিনি নতুন নতুন ভিডিও দেখতে পারেন। ব্যবহারকারীরা নিজেদের মধ্যেও ব্যক্তিগত বার্তা আদান-প্রদান করতে পারেন।

সহজ কথায়, যারা কিছুটা অভিনয় করেন বা কমেডি করতে পারেন, তাদের প্রতিভা তুলে ধরার জন্য টিকটক নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উঠে এসেছে। টিকটকের জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে : এসব ভিডিও আকারে ছোট, ব্যবহার করা সহজ, সব সময় এতে যুক্ত হয় নতুন নতুন ফিচার, ভিডিওতে নিজের কণ্ঠ মেলানো যায়, ভিডিওতে অন্যের কণ্ঠও ব্যবহার করা যায়। করোনা সংকটের সময় টিকটকের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। ঘরবন্দি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয় এর প্রতি। বলা হচ্ছে, টিকটক ও তার সহযোগী অ্যাপ দোইনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি। দোইন অ্যাপটি শুধু চীনে ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন টিকটকার ভালো উপার্জন করছেন। চলচ্চিত্র, টিভি, সংগীতের অনেক তারকাও আছেন এতে। ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবের পর নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন শ্রেণির দর্শকের কাছে পৌঁছার জন্যই তাদের এ প্রচেষ্টা।

এ কথা সত্য যে, জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারতে টিকটক নিষিদ্ধ করার আগে এটি সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে দেশে দশ কোটিরও বেশি মানুষ এরই মধ্যে টিকটক ডাউনলোড করেছে। ২০১৮ সালে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা হয় টিকটক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অবস্থা যা-ই হোক, আমাদের দেশের বেশ কটি ঘটনা হতাশ করেছে। কারণ টিকটক ব্যবহারের নামে উন্মাদনা, বাড়ি থেকে পালানো, নারী পাচার, ধর্ষণ ও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার দিবস ২০২১ উপলক্ষে এক আলোচনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা টিকটক, লাইকির লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে মানব পাচারের শিকারে পরিণত না হয়।’

কেননা ছিনতাইয়ের অভিযোগে এক নারী টিকটকার আটক হয়েছেন। টিকটক বানিয়ে তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী করার অপরাধে ৯ জনকে আটক করেছে রাজশাহী নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে টিকটক করতেন একজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ‘টিকটক রাজ’ নামে পরিচিত। এ পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে নারীদের ফাঁদে ফেলতেন। এরপর অনৈতিক সম্পর্ক, ব্ল্যাকমেইল আর অর্থ আত্মসাৎ করতেন। অবশেষে তিনি ধরা পড়েছেন র‌্যাবের জালে। এ ছাড়া জাতীয় সংগীতের অবমাননা করে টিকটক ভিডিও বানানোর অভিযোগে পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। গত ২৩ আগস্ট রাতে বগুড়ায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।

টিকটকের কনটেন্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর বেশির ভাগ মানহীন, ভীতিকর, সম্মানহানিকর, অশ্লীলতায় ভরপুর। অনেকে রাস্তা আটকে, হাটবাজারে, জনসমাগমের ভেতরে টিকটক তৈরি করেন। ফলে দুর্ঘটনা, মারামারি, বিরক্তিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। তাই এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে পরিবারকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। তার সন্তান কী করছে, কোন ধরনের কনটেন্ট তৈরি করছে; তা খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে স্থানীয় প্রশাসন নজরদারি বাড়াতে পারে। পাবলিক প্লেসে অন্যের কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে যেন কেউ টিকটক না বানায়, টিকটকের নামে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে। এর জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত। সুষম দিকনির্দেশনা থাকলে ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

‘ল অ্যান্ড লাইফ’ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছার গত ২৪ জুন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করেন। তাতে বলা হয়, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিধায় কঠোরভাবে মনিটর করা প্রয়োজন। অনৈতিক এসব গেমস থেকে রক্ষা করতে শিশুদের জন্য উপযোগী ও যথাযথ অনলাইন গেমস তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষতিকর গেমস এবং অ্যাপস অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর এবং উপযোগী সাইবার পদ্ধতি সুনিশ্চিত করতে সরকারের একটি কমিটি থাকা প্রয়োজন।’ এ রিটের পর গত ১৬ আগস্ট দেশের সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেম, লাইকিসহ এ ধরনের সব অনলাইনভিত্তিক খেলা ও অ্যাপস অপসারণ এবং সব লিংক বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেমস তথা লাইকির মতো সব ধরনের অনলাইন গেম এবং অ্যাপস বন্ধের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত। বিষয়টি এখন আইনি প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তার পরও টিকটক ব্যবহারকারীদের সংযত হতে হবে। সম্ভাবনাময় একটি প্ল্যাটফর্ম মুষ্টিমেয় অপব্যবহারকারীর জন্য বন্ধ হয়ে গেলে খুব বেশি ক্ষতি না হলেও লাভবান হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই প্রত্যাশিত।

লেখক : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION