শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে:
পরিচ্ছন্ন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। কেয়াবন ও প্রবাল থেকে শুরু করে সাগরে যত্রতত্র বর্জ্যরে কারণে দূষিত হচ্ছে দ্বীপের নীল জলরাশি। দ্বীপজুড়ে মনুষ্যত্বের ব্যাপক ছাপে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র। তাই, এসব প্রতিরোধে কার্যকর দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে বলে ধারণা করছেন পরিবেশবাদি ও বিজ্ঞানীরা।
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্বচ্ছ নীল জলরাশি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে দ্বীপটিতে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমে ভ্রমনে আসে হাজারো পর্যটক। এসব পর্যটকদের কারণে দ্বীপ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে বিধি-নিষেধ আরোপ কওে নানামুখী আইনী পদক্ষেপ নিয়েছেন সরকার। এজন্য কাজ করছেন পরিবেশ অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। কিন্তু, আইন আছে যেন প্রয়োগ নেই। পুরো দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিকজাত চিপস প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, বোতল, পানির বোতল, পানির প্লাস, ডাবের খোসা, ডাবের পানি খাওয়ার স্ট্র, খাবার প্যাকেট, ভাঙা চশমা বা কাঠি, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্য। এছাড়াও ছোটবড় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি সঙ্গে যোগ হয় গৃহস্থালির ফেলা বর্জ্য। আর এসব ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে চারপাশে। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর সহ দ্বীপ নিয়ে কাজ করা সংস্থার কর্মকর্তাদের কাযক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে স্থানীয়রা।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রশীদ আহমদ কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘দ্বীপকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডের কথা আমরা শুনি। কিন্তু, বাস্তবে কিছু দেখতে পায় না। পুরো সেন্টমার্টিন জুড়ে রয়েছে ময়লা-আবর্জনা। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট গুলোর বর্জ্য যাচ্ছে সরাসরি সাগরে। এগুলো দেখার জন্য সেন্টমার্টিনে কেউ নেই।’
একই এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে আব্দুর রহিম কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমনে আসেন। এসব পর্যটকরা কয়েক হাজার কেজি বর্জ্য সৃষ্টি করে। যে পরিমাণ বর্জ্য বের হয় তা ধারণের ডাস্টবিন এই দ্বীপে নেই। মাঝেমধ্যে কিছু প্লাস্টিকের বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হলেও বছরের বেশির ভাগ সময় বর্জ্য ডাস্টবিনে খোলা আকাশের নিচে থেকে যায়। এসব গিয়ে মেশে সমুদ্রে।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমাটিনে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন। এই দ্বীপে অবস্থিত শতাধিক হোটেল-মোটেলকে বারবার নির্দেশ দেয়া হয় যেন তাদের ময়লা-আবর্জনাগুলো ডাস্টবিনে ফেলে। কিন্তু, কেউ কারও কথা শুনেনা। কেউ কেউ সেই নির্দেশনা মানলেও দেখা যায় অনেকে উদাসীন। দ্বীপের সমস্ত বর্জ্য সংগ্রহ করে বড় ডাস্টবিনে রেখে সপ্তাহ দুয়েক পরপর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু, আমি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর এসব আর হয়না। ফলে দ্বীপের চারপাশ এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু সাইনবোর্ডে লাগানো হয়েছে। তাঁরা পর্যটক এবং স্থানীয়দের স্বার্থে কিছুই করেন না। দ্বীপ এবং সৈকত পাড়ে রয়েছে ছোট্ট অগণিত দোকান। এসব দোকানীরা ডাব, পানীয় এবং খাদ্য জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে পর্যটন মৌসুমে ভাল ব্যবসা করেন। কিন্তু, সৈকত পাড়ের দোকানীরা বীচের আশে পাশে ময়লা আবর্জনা রেখে দেন। ডাবের কোষাসহ ময়লা-আবর্জনায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
সেন্টমার্টিনে দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী আব্দুল হামিদ কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে না ফেলতে প্রতিনিয়ত সচেতনতামুলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু, ভ্রমনে আসা পর্যটকরা কোন কথা পাত্তা দেয় না। এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর একা কোনভাবে দ্বীপ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ দ্বীপে দায়িত্বরত প্রশাসন কোন ধরণের সহযোগিতা করেন না।’
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমনে আসা প্রকৌশলী পারভিন আক্তার কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘দ্বীপের সৌর্ন্দয্য রক্ষার্থে ময়লা-আবর্জনা প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র রক্ষায় এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তা নাহলে দিনদিন দ্বীপের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যাবে এবং দূষিত হতে পারে’।
আরেক পর্যটক রিতা আক্তার জানান, ‘পুরো সেন্টমাটিনটি মনে হয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেই্ কারণ, দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যে যেভাবে বাড়তি দাম নিচ্ছে, পরবর্তী হয়তো কমে আসবে পর্যটকদের সংখ্যা। তাই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘দ্বীপ রক্ষায় একের পর এক প্রকল্প গ্রহন করছে সরকার। কিন্তু, কোনভাবে কাজে আসছে না। দ্বীপের চারদিকে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ।’
সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিভিন্ন দুষণের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘অতিরিক্ত পর্যটক ভ্রমনে দ্বীপের নানা রকম বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষণ হচ্ছে দ্বীপ। এজন্য অন্তত পর্যটন এলাকা গুলোতে পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট ব্যবহার বন্ধে সুপারিশ করা হয়েছে।
এই সমুদ্র বিজ্ঞানী বলেন, ‘পরিবেশবিরোধী এসব ময়লা-আবর্জনায় হারিয়ে যেতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ। নষ্ট হতে পারে দ্বীপের প্রকৃতি। এমনকি দূষণের কারণে মানচিত্র থেকে হারিয়েও যেতে পারে একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি।
গত ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকত এলাকাসহ দেশের ৬টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়া স্বত্বেও পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণ কাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকান্ডের কারণে গত দেড়যুগে দ্বীপের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মানা হচ্ছেনা কোনটিই। ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আইন লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল।
এব্যাপারে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম কক্সবাজার ভয়েসকে জানিয়েছেন, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে বৃহস্পতিবার চার রিসোর্টকে সাড়ে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এসময় অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণের দায়ে আটলান্টিক রিসোর্ট ও ড্রিমস প্যারাডাইস রিসোর্টকে এক লাখ টাকা করে, ফ্রেন্ডস রিসোর্টকে ৫০ হাজার ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়ে প্রিন্স হ্যাভেন রিসোর্টকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানের সময় সঙ্গে ছিলেন পুলিশের সদস্য ও পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।’
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি। দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তুপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল। একারণে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ-তে ৯টি পয়েন্টের নিষিদ্ধ কার্যক্রম রোধ কল্পে) আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, দ্বীপে প্লাষ্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা, পর্যটক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করা, ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করা, দ্বীপে স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, দ্বীপে নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করা, পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যতিত হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি বন্ধ করা, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য ও দ্বীপ রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করাসহ নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক দ্বীপ ভ্রমনের কারণে সাগরপাড়ের কেয়াবন, শৈবাল-প্রবাল থেকে শুরু করে ছড়িয়েছে সাগরের তলদেশেও। ফলে পরিবেশগতভাবে চরম হুমকিতে দ্বীপটি। তাই, প্রশাসনিক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরধারির পাশাপাশি দ্বীপকে বাঁচিয়ে রাখার আহবান সকলের।
ভয়েস/আআ