সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৫ অপরাহ্ন
শায়খ ড. খালেদ বিন সুলায়মান আল মুহান্না:
যেভাবে মানবদেহ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ ছাড়া বাঁচে না, তেমনি রুহ (আত্মা) তার প্রয়োজনীয় খোরাক ছাড়া বাঁচতে পারে না। রুহের খোরাক হলো মহান আল্লাহর জিকির। সহিহ বোখারিতে হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার রবের জিকির করে আর যে রবের জিকির করে না, তার উদাহরণ জীবিত ও মৃতের মতো।’ মহান রবের জিকিরকারীর জীবনই প্রকৃত জীবন। কেননা এই জীবন ব্যক্তির মৃত্যু ও দেহের বিনাশের পরও বেঁচে থাকে; যেহেতু রুহ নিঃশেষ হয় না বরং তা দেহ থেকে আলমে বারজাখে (মৃত্যুর পর কেয়ামত ও হাশর পর্যন্ত কালকে বারজাখ বলা হয়) স্থানান্তরিত হয় মাত্র। অন্তরের জন্য আল্লাহর জিকিরের গুরুত্ব সেরূপ, চাষাবাদের জন্য পানির গুরুত্ব যেরূপ। আল্লাহর জিকির না করলে মানুষের অন্তর ও জীবন চতুষ্পদ জন্তুর জীবন ও অন্তরের মতো হয়ে যায়। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা কুফরি (আল্লাহর অবাধ্যতা) করেছে তারা ভোগবিলাস করে এবং খায় জাহান্নামই তাদের নিবাস।’ -সুরা মুহাম্মদ : ১২
জিকির না করলে অন্তর উদাস হয় ও পাপের মরিচা পড়ে। এর নিরাময় হলো- ইস্তেগফার ও জিকির। জিকিরের মাধ্যমে বিপদাপদ দূরীভূত ও বালা-মুসিবত হালকা হয়। এতে রয়েছে অন্তরের উজ্জ্বলতা ও পরিচ্ছন্নতা এবং যখন হৃদয় রোগাক্রান্ত হয় তখন এটাই তার ওষুধ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অধিক ফজিলতপূর্ণ একটি জিকির হলো- বিশ্বপ্রভুর তাসবিহ পাঠ করা। কেননা সর্বোত্তম স্থানে ফেরেশতারা এ জিকিরই করেন। এটা তাদের রাতদিনের কর্ম। এ-কাজে তারা ক্লান্ত হন না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি ফেরেশতাদের দেখতে পাবেন যে, তারা আরশের চারপাশে ঘিরে তাদের রবের সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করছে।’ -সুরা যুমার : ৭৫
দুনিয়ার নানাবিধ বিপদ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বান্দার জন্য এটাই অবলম্বন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করুন, যুন-নূনকে, যখন তিনি ক্রোধ ভরে চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে পাকড়াও করব না। তারপর তিনি অন্ধকারে এ আহ্বান করেছিলেন যে, আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; আপনি কতই-না পবিত্র ও মহান, নিশ্চয়ই আমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছি! তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।’ -সুরা আল আম্বিয়া : ৮৭-৮৮
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যখনই কোনো নবী বিপদগ্রস্ত হয়েছেন, তখনই তিনি তাসবিহ পাঠের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন।’ তাসবিহ হচ্ছে সিজদাকারীদের শ্রেষ্ঠ জিকির। আল্লাহর কাছে প্রিয় জিকির এবং এর মাধ্যমেই মিজানের পাল্লা ভারী হবে। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি বাক্য যা উচ্চারণে হালকা, ওজনে ভারী, দয়াময়ের কাছে অতি প্রিয়; সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম।’ -সহিহ বোখারি
এটা এমন জিকির যা ফজিলতের দিক থেকে অন্যসব জিকিরের ওপর প্রণিধানযোগ্য। উম্মুল মুমিনিন হজরত জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার নবী কারিম (সা.) ফজরের নামাজের পর সকালে তার কাছ থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর তিনি নামাজের স্থানে বসে ছিলেন। চাশতের পর রাসুল (সা.) ফিরে এসে দেখলেন, তিনি সেখানেই বসে জিকিরে মগ্ন আছেন। তারপর তিনি বললেন, তুমি তখন থেকে সে অবস্থায়ই আছ যেভাবে আমি তোমাকে রেখে গিয়েছিলাম! তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন নবী কারিম (সা.) বললেন, আমি তোমার কাছ থেকে বের হওয়ার পর চারটি বাক্য তিনবার পাঠ করেছি, যদি সেগুলোকে তুমি আজ এ যাবৎ যা পাঠ করেছ তার সঙ্গে ওজন করা হয়, তাহলে সেগুলোই অধিক ভারী হবে। সেগুলো হলো- সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি আদাদা খালকিহি, ওয়ারিজা নাফসিহি, ওয়া জিনাতা আরশিহি, ওয়া মিদাদা কালিমাতিহি। -সহিহ মুসলিম
তাসবিহের আরেকটি ফজিলত হলো- মহান আল্লাহ এটাকে জান্নাতে তার প্রিয় বান্দাদের জিকির হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এটা পাঠের স্বয়ংক্রিয় সক্ষমতা তাদের দেওয়া হবে যেমনভাবে দুনিয়ায় স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাসের সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতবাসীরা জান্নাতে পানাহার করবে, তবে তারা সেখানে পেশাব-পায়খানা করবে না ও তাদের শ্লেষ্মা ঝরবে না। কিন্তু তাদের সেই খাদ্য মিসকের সুগন্ধির মতো ঘাম ও ঢেঁকুরের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাসবিহ ও তাহমিদ পাঠের স্বয়ংক্রিয় সক্ষমতা তাদের দেওয়া হবে যেমনভাবে দুনিয়ায় স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাসের সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’ -সহিহ মুসলিম
রবের কাছে অধিক প্রতিদান লাভ ও গোনাহ মোচনের জন্য তাদের অন্যতম মাধ্যম এটা। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি হজরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, ‘একদা আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি প্রতিদিন এক হাজার নেকি অর্জন করতে সক্ষম হবে? তখন সেখানে বসে থাকা লোকদের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করল, আমাদের কেউ কীভাবে এক হাজার নেকি অর্জন করবে? তিনি বললেন, সে একশ বার তাসবিহ পাঠ করলে তার জন্য এক হাজার নেকি লিখিত হবে অথবা তার এক হাজার পাপ মোচন করা হবে।’ -সহিহ মুসলিম
তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশ বার বলবে, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি’, কেয়ামতের দিন কেউ তার চেয়ে উত্তম আমল নিয়ে আসতে পারবে না, তবে সে ব্যক্তি ছাড়া যে তা অনুরূপ বা তার চেয়েও বেশি পাঠ করবে।’ -সহিহ মুসলিম
তাসবিহ রবের প্রতি বান্দার সন্তুষ্টির মাধ্যম এবং তার শরিয়ত ও নির্দেশ পালনের অন্যতম উপকরণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাসবিহ পাঠ করো রাতের কিছু অংশে ও দিনের প্রান্তসমূহে, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পারো।’ -সুরা ত্ব-হা : ১৩০
তাসবিহ অন্তরের প্রশস্ততা ও তা থেকে সংকীর্ণতা দূরের মাধ্যম। যেসব গুণ আল্লাহর সম্মান, পবিত্রতা ও মহত্ত্বের সঙ্গে মানানসই নয় এবং মুশরিকরা যেসব গুণে তাকে গুণান্বিত করে তা থেকে আল্লাহকে মুক্ত ঘোষণা করা। ওই ব্যক্তির অবাধ্যতার মতো অবাধ্যতা থেকে আল্লাহকে মুক্ত রাখা, যে মহান আল্লাহর সম্মানের পরোয়া করে না ও তাকে ভয়ও করে না। তাসবিহ হলো- বান্দার পক্ষ থেকে অপারগতা ও অজ্ঞতার স্বীকারোক্তি প্রদান, রবের কাছে আনুগত্য প্রকাশ এবং তার পূর্ণাঙ্গ ইলম ও হিকমতের স্বীকৃতি। তাসবিহ পাঠে রয়েছে দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ঘোষণা আর তাহমিদে রয়েছে মহান রবের পূর্ণাঙ্গ গুণাবলির সাব্যস্তকরণ।
অধিক পরিমাণে তাসবিহ পাঠের সক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ ও সম্মান। এর কারণ দুটি- এক. বান্দা কর্র্তৃক তাসবিহের ফজিলত ও তার বিশাল মর্যাদা সম্পর্কে জানা। দুই. ইহ ও পরজগতে আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি, পরিচালনা ও নিয়ামতরাজি এবং কর্ম সম্পর্কে বান্দা কর্র্তৃক গবেষণা করা।
সর্বদা আমাদের রব আল্লাহতায়ালার তাসবিহ পাঠ করা, এগুলোর অর্থ জানা, ফজিলত অনুধাবন ও সওয়াবের প্রত্যাশা করা জরুরি বিষয়। যাতে আমাদের রুহ প্রশান্তি লাভ করে, অন্তর প্রফুল্ল হয় এবং আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরের অগণিত সুফল রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- এটা আল্লাহর আজাব থেকে মুক্তির উপায়। সাহাবি হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর জিকির অপেক্ষা আজাব থেকে অধিক নাজাত প্রদানকারী কোনো আমল আদম সন্তান সম্পাদন করতে পারে না।’
বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরের আরেকটি সুফল হলো, জিকিরকারী বান্দার সঙ্গে আল্লাহ থাকেন। সুতরাং তাকবির, তাহলিল, তাসবিহ, তাহমিদ ও ইস্তিগফারকারী বান্দার সঙ্গে আল্লাহ থাকেন; তাকে হেফাজত, সাহায্য, রক্ষা ও সহযোগিতা করেন। জিকিরের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সাহায্য-সহযোগিতা আসে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক অনুযায়ী প্রতিদান মেলে।
১৬ ডিসেম্বর শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা।
অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান