সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪০ অপরাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
বিভিন্ন রকম নিন্দনীয় রীতিনীতির পাশাপাশি ইংরেজি নববর্ষ বরণে নতুন একটি রীতি কয়েক বছর ধরে খুবই প্রকট ও মারাত্মক হয়ে উঠেছে। সেই রীতি হচ্ছে, আতশবাজি। নিয়ম করে ৩১ ডিসেম্বর রাতে ইংরেজি নববর্ষের সূচনা মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় আতশবাজি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। রাত ১২টার সময় এ আতশবাজি শুরু হয়। আতশবাজির পাশাপাশি ৩১ ডিসেম্বর রাতে নানারকম নিষিদ্ধ আনন্দ-ফুর্তি, অশ্লীলতা, মদ্যপান, নাচগান ও সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের রেওয়াজ তো বেশ কয়েক বছর থেকেই চলে আসছে। উন্মত্ততাপূর্ণ এসব আনুষ্ঠানিকতার কারণে অনেক রকম অপ্রীতিকর ঘটনাও ইতিমধ্যে ঘটেছে। যে কারণে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশসহ কোথাও কোথাও ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।
দীর্ঘ সময় নিয়ে বড় ধরনের আতশবাজির ভয়ংকর আনুষ্ঠানিকতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অথচ এ সংস্কৃতি দিন দিন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে চলেছে। শুধু নববর্ষের উৎসবেই এটি থেমে নেই। বরং বিভিন্ন খেলা, টুর্নামেন্ট ও উৎসবে আতশবাজির প্রয়োগ বাড়ছে। এটা বিভিন্ন দেশেই ঘটে চলেছে। এমনকি আমাদের দেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। আতশবাজি বা কোটি কোটি টাকার আগুন-পটকা ফোটানোর উৎসব এখন আর ধনী দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
সম্প্রতি বিশ্ব সংস্থা অক্সফামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর এক শতাংশ ধনী যে পরিমাণ সম্পদ ভোগদখল করেন তা বাদবাকি নিরানব্বই শতাংশ মানুষের সমান। বিপুল বৈষম্য, অসম বণ্টন ও সম্পদ কুক্ষিগতকরণের চিত্র এটি। এর একটি উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে এসব আতশবাজিতে। টাকাওয়ালারা টাকা উড়াচ্ছে। কোটি কোটি টাকা কয়েক মুহূর্তেই আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসে মিলিয়ে দিচ্ছে। এ নিয়ে তারা কোনো রকম বিকার ও অস্বস্তিতেও ভুগছে না। চোখের সামান্য সুখের জন্য কয়েক মুহূর্তে সম্পদ জ্বালিয়ে দেওয়ার উৎসব চলছে। অথচ বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। স্বাভাবিক অন্নবস্ত্র তারা পায় না। সেখানে ধনী-গরিব কোনো রাষ্ট্রেরই এমন অপচয়মূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার অর্থ দরিদ্রদের দারিদ্র্যের প্রতি কটাক্ষপাত। ধনী রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব তাদের অতিরিক্ত সম্পদ দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা। সে দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে আগুনে টাকা পুড়িয়ে উৎসব করার মানে দারিদ্র্যের প্রতি অমানবিক উপহাস। ইসলাম এ জাতীয় উৎসবকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।
ধনী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ওপরের কথাগুলো স্বাভাবিক যুক্তি ও বিবেচনা বোধেরই দাবি। এটা তাদের করা উচিত ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসন ও চরম দারিদ্র্যের অসহায়ত্ব দূর করার দায়িত্ব থেকে। কিন্তু এ বিষয়টিতে অনুন্নত কিংবা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব তো অনেক বেশি। আতশবাজির পেছনে কোটি কোটি টাকা উড়িয়ে দেওয়ার মতো হঠকারিতা তাদের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। একে তো বহু গরিব মুসলিম দেশে দারিদ্র্য নিরসন এবং স্বাভাবিক রাষ্ট্রীয় চাহিদা পূরণেই অনেক অর্থের প্রয়োজন। যে প্রয়োজনীয়তা পূরণে যথাযথ অর্থের সংস্থান করা নিজেদের উৎস থেকে তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে ক্ষেত্রে অপচয় না করে তাদের সহযোগিতা দিয়ে যাওয়া বিত্তবান মুসলিম দেশগুলোর দায়িত্ব।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, আতশবাজির বিষয়টি কোন পর্যায়ের এবং কত জঘন্য রকম একটি বিলাসিতা। বিত্তবানেরা অনেক রকম বিলাসী আয়োজনে টাকা নষ্ট করে। সেখানে পেটের কিংবা মনের কিছু সময়ের ভোগ তাদের হয়। নিন্দিত সেই ভোগ-উপভোগেরও একটি স্তর থাকে। কিন্তু আতশবাজি একটি চরম ও অকল্পনীয় বিলাসী খাত। এ যেন বস্তা বস্তা টাকা আগুনে পুড়িয়ে কয়েক মিনিটের ফুর্তি করা। যে ফুর্তি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। হারিয়ে যায়। অথচ এ টাকাগুলো বাঁচানো গেলে লাখ লাখ দরিদ্র লোকের কাজে লাগত। তাদের ক্ষুধা নিবারণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয়ন ও আবাসনের আয়োজন করা যেত।
এ তো গেল আতশবাজির ভয়াবহতার একটি অর্থনৈতিক দিকের আলোচনা। যদি এ বিষয়টিকে ইসলামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে বিবেচনা করা হয় তাহলেও এ জাতীয় আগুনের উৎসব মুসলমানদের জন্য চেতনাগত ও সাংস্কৃতিকভাবেও বর্জনীয়।
সে জন্য আমরা জোর দিয়ে বলব, ফুর্তি ও অনুষ্ঠান সবকিছুতেই আতশবাজির ফেতনা ও মহামারী কিংবা আগুনের ব্যবহার থেকে মুসলমানদের মুক্ত হওয়া উচিত। এই ভয়ংকর অপচয় ও অনুচিত সংস্কৃতি মুসলমানদের জন্য কিছুতেই অনুসরণযোগ্য ও পালনযোগ্য হতে পারে না। হতে পারে না তাদের প্রতিযোগিতা ও মর্যাদা রক্ষার কোনো ইস্যু। ধ্বংসাত্মক অপচয়ের মধ্যে মুসলিম কোনো সমাজের কোনো গৌরব ফুটে ওঠার কোনো অবকাশ নেই। একইসঙ্গে অন্য ধর্মের অনুসারীদের জন্যও আতশবাজির মতো অনুষ্ঠানে, যেটি কোটি কোটি ‘টাকা’ আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো অপচয়ে না যাওয়ারও পরামর্শ থাকবে। কারণ শাশ্বত মানবিক ক্ষেত্রগুলোর ক্ষয় ও ক্ষতি সবার জন্যই সমান বিনাশ নিয়ে আসে। আমাদের দেশের জনগণ এবং সরকারের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান থাকবে।
ভয়েস/আআ