সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩৭ অপরাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ছিলেন ইতিহাসে এমন এক মহান সেনাপতি, যিনি রণক্ষেত্রে নিজের শক্তি ও মেধার দ্বারা ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত করেছিলেন। মিসরের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে তার সামরিক ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে বলেন, ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলিই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অসীম বাহাদুরি, অনুপম সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ্ম মেধা, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর ওপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।’
ইসলাম গ্রহণের আগে ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তার বিচক্ষণ রণকৌশলে মুসলিম বাহিনীকে কিছুটা ধরাশায়ী হতে হয়। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মাত্র ১৪ বছর জীবিত ছিলেন। এ অল্প সময়েই তিনি মোট ১৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। দ্রুত সম্প্রসারণমান ইসলামি সাম্রাজ্য হজরত খালিদ (রা.)-এর হাতেই বিস্তৃত হয়। ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে মুসলমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে বিখ্যাত যে ইয়ারমুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)। তার অসীম সাহসিকতায় মুসলমানরা বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। সামরিক ইতিহাসে এই যুদ্ধ অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়। মুতার যুদ্ধে তিনি এতটাই বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন যে তার হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে যায়। এ প্রসঙ্গে বোখারিতে স্বয়ং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুতার যুদ্ধে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙেছে। এরপর আমার একটি ইয়ামানি তলোয়ার অবশিষ্ট ছিল।’
হজরত খালিদ (রা.)-এর রণনিপুণতায় খুশি হয়ে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফ বিজয় ও তাবুক অভিযান উল্লেখযোগ্য। তিনি খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও খলিফা ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালেও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ইতিহাসবিদেরা খালিদ বিন ওয়ালিদকে সমর ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেনাপতি বলে মেনে নিয়েছেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ ৫৯২ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়ালিদ বিন আল মুগিরা ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের প্রধান। খালিদরা ছিলেন পাঁচ ভাই আর দুই বোন। জন্মের পরপরই আরব প্রথা অনুযায়ী তাকে বেদুইন দুধমায়ের কোলে তুলে দেওয়া হয়। এরপর পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ গড়নের আর অসম্ভব ডানপিটে। ঐতিহ্যগতভাবেই কুরাইশদের সেরা যোদ্ধা আর কমান্ডাররা সবাই ছিলেন বনু মাখজুম গোত্রের। তাই ছেলেবেলা থেকেই তিনি ঘোড়ায় চড়া ও তরবারি, তীর, বর্শা আর বল্লম চালানো শিখতে শুরু করেন।
যদিও বল্লম ছিল তার প্রিয় অস্ত্র, কিন্তু অন্যসব অস্ত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। এ ছাড়া তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের সেরা কুস্তিগিরদের একজন। একবার মল্লযুদ্ধে হজরত উমর বিন খাত্তাবকে আছড়ে ফেলে তার পা ভেঙে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সম্পর্কের দিক থেকে উমর বিন খাত্তাব ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদের ভাগনে।
খালিদের বাবা আল ওয়ালিদ ছিলেন ইসলামের ঘোর বিরোধী। বদরের যুদ্ধে খালিদের এক ভাই মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। যুদ্ধশেষে খালিদ তার বড় ভাইকে চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু ফেরার পথে সে পালিয়ে মদিনায় ফিরে যায় এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। খালিদ উহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশদের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়েন। ৬২৮ সালে হুদাইবিয়ার সন্ধি হয়। এরই মধ্যে ওয়ালিদ মদিনা থেকে চিঠির মাধ্যমে খালিদকে বারবার ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিতে থাকেন। একপর্যায়ে খালিদ মদিনা গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তার বাল্যবন্ধু ইকরিমা এবং কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ক্ষিপ্তভাবে তাকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ৩১ মে ৬২৯ সালে খালিদ মদিনা গমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি একজন যোদ্ধা হিসেবে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন।
৬৩০ সালে কুরাইশদের বিরুদ্ধে মক্কাবিজয় অভিযানে খালিদ চার মুসলিম বাহিনীর একটির সেনাপতি হিসেবে অংশ নেন। ওই বছরই তিনি হুনাইনের যুদ্ধে এবং তায়েফ অবরোধ অভিযানে অংশ নেন। এরপর তিনি বাইজেন্টাইনদের আগ্রাসন ঠেকাতে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নেতৃত্বে তাবুক অভিযানে অংশ নেন। কিন্তু মুসলমান বাহিনী তাবুক পৌঁছানোর আগেই বাইজেন্টাইনরা তাবুক ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ায় নবী করিম (সা.) খালিদকে চার শত সৈন্যসহ দুমা অভিযানে পাঠান। দুমাতুল জান্দালের রাজকুমার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তার ইহুদি আর খ্রিস্টান প্রজাদের নিয়ে ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন। ৬৩১ সালের এপ্রিল মাসে খালিদ দুমাতুল জান্দালে পুনরায় অভিযান চালান এবং এবার সর্পদেবতা ওয়াদের মূর্তি ধ্বংস করেন।
৬৩২ সালে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর অনেক শক্তিশালী আরব গোত্র খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে শুরু করে। ফলে শুরু হয় রিদ্দাহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনাপতি নিয়োগ করলে তিনি মধ্যআরবে অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। বুজাখা আর ঘামরার যুদ্ধে তিনি স্বঘোষিত নবী তুলাইহার বাহিনীকে পরাস্ত করেন।
খালিদের পরামর্শে ৬৩৬ সালের ২০ আগস্ট ইয়ারমুক প্রান্তরে মুসলমান বাহিনী বাইজেন্টাইন বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে। ইয়ারমুখে বাইজেন্টাইনদের পরাস্ত করার পর মুসলমান বাহিনী লেভান্টে বাইজেন্টাইনদের শেষ শক্ত ঘাঁটি জেরুজালেম অবরোধ করে। দীর্ঘ চার মাস অবরোধের পর ৬৩৭ সালের এপ্রিলে খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর উপস্থিতিতে জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করে। জেরুজালেম পতনের পর হজরত আবু উবায়দা (রা.) আর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) উত্তর সিরিয়া অভিযানে যান। পথে হাজিরের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাস্ত করে ৬৩৭ সালের অক্টোবরের ভেতর আলেপ্পো পর্যন্ত দখল নেন। এরপর খালিদ আরও উত্তরে এগোতে থাকেন। তিনি সফল অভিযানের মাধ্যমে জাজিরা, এডেসা, আমিদা, মালাটিয়া, আর্মেনিয়া আর মধ্য আনাতলিয়া পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। পরে নানা কারণে খলিফা উমর (রা.) মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযান বন্ধ করে দখলকৃত এলাকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা জোরদারে মনোযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। ফলে আনাতালিয়া আর আর্মেনিয়া অভিযানের মাধ্যমে খালিদ বিন ওয়ালিদের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
৬৪২ সালের হজ শেষে খলিফা হজরত উমর (রা.) অসমাপ্ত পার্সিয়ান অভিযান পুনরায় শুরুর পরিকল্পনা করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদকে ওই অভিযানের সেনাপতি পুনর্নিয়োগের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু মদিনা পৌঁছে তিনি শুনেন খালিদ বিন ওয়ালিদ আর নেই। ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সিরিয়ার হিমসে খালিদ বিন ওয়ালিদকে সমাহিত করা হয়। পরে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
ভয়েস/আআ