শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১২ অপরাহ্ন
নিতাই চন্দ্র রায়:
ইফতারের সময় এক গ্লাস গুড়ের শরবত রোজদারদের দেহমনে নিয়ে আসে এক নিবিড় প্রশান্তি। গুড়ের গ্লুকোজ শরীরে সরাসরি শক্তি জোগায়। ক্লান্তি দূর করে। এ কারণে আবহমান কাল থেকে রোজার সময় গ্রামের মানুষ গুড়ের শরবত পান করে আসছেন। পানীয় প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডার মধ্যেও গুড়ের শরবত এখনো মানুষের
তৃষ্ণা নিবারণে অনন্য উপকরণ হিসেবে সমাদৃত। রোজা এলে চিনি, ডাল, তেল ও দুধ, মাংস, ডিমের মতো গুড়ের দামও বেড়ে যায়। বর্তমানে দেশের বাজারে প্রতি কেজি আখের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা, খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আখের গুড়ের দাম বেড়েছে ৬০ টাকা আর খেজুর গুড়ের দাম বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
গুড় চিনির চেয়ে অধিক পুষ্টিকর। সাদা চিনিতে শুধু শর্করা ও সামান্য আয়রন ছাড়া আর কিছু নেই। অন্যদিকে গুড়ে শর্করা ছাড়াও রয়েছে প্রোটিন, ফ্যাট, বিভিন্ন খনিজ লবণ ও ভিটামিন। খেজুর ও তালের গুড়ে রয়েছে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম। গুড়ে অধিক পরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকার কারণে দেহে দ্রুত শক্তি জোগায়। মিষ্টতার দিক থেকেও গুড় চিনির চেয়ে দেড়গুণ মিষ্টি। শরবত ছাড়াও মিঠাই, মন্ডা, সন্দেশ, নাড়ু, মোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের আচার, রকমারি পিঠা এবং পায়েস তৈরিতে গুড়ের কোনো বিকল্প নেই। আয়ুর্বেদীয়, হেকিমি ও কবিরাজি ওষুধ তৈরির কাজেও গুড় ব্যবহার করা হয়। পুরাতন গুড়, রোগপ্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশে সাধারণত আখ, খেজুর, তাল ও গোলপাতার রস থেকে গুড় তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে বেশিরভাগ গুড় উৎপাদিত হয় আখের রস থেকে। দেশে মিলজোন ও মিলজোন বহির্ভূত এলাকায় আখ থেকে গুড় উৎপাদিত হয়। মিলজোন বহির্ভূত এলাকার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, শরিয়তপুর, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও হবিগঞ্জে বেশি পরিমাণে গুড় উৎপাদিত হয়। আর মিলজোন এলাকার মধ্যে অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার ব্যবহারের মাধ্যমে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে প্রচুর পরিমাণে গুড় উৎপাদন করা হয়।
আজ থেকে ৪/৫ বছর আগেও বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হতো। উৎপাদিত আখের শতকরা ৫০ ভাগ গুড় ২৫ থেকে ৩০ ভাগ চিনি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হতো। বাকি ২০ থেকে ২৫ ভাগ আখ চিবিয়ে খাওয়া, রস উৎপাদন ও বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতি বছর দেশে গড়ে আখ থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন গুড় এবং তাল, খেজুর ও গোলপাতা থেকে বছরে বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হতো। সে হিসেবে দেশে প্রতি বছর উৎপাদিত হতো ৩ লাখ ৬০ থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন গুড়। বর্তমানে তা কমে ২ থেকে ২.৫ লাখ টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
২০২০ সালে ৬টি সরকারি চিনিকল বন্ধ করার হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে মিলজোন এলাকায় আখের আবাদ ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে দেশের চিনি ও গুড় উৎপাদনে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল এবং গুড় উৎপাদন কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য হওয়ায় মিল বহির্ভূত এলাকায়ও ব্যাপকভাবে গুড় উৎপাদনের কাঁচামাল আখের আবাদ হ্রাস পায়। জনপ্রতি বার্ষিক ৬ কেজি হিসেবে দেশে মোট বার্ষিক গুড়ের প্রয়োজন প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন।
গুড় চিনির চেয়ে পুষ্টিকর হলেও বাংলাদেশে উৎপাদিত গুড়ের প্রায় শতভাগ ভেজাল ও অনিরাপদ বললে মোটেও ভুল হবে না। এক শ্রেণির লোভী গুড় উৎপাদনকারী আখের রসের সঙ্গে পশুখাদ্য হিসেবে পরিচিত চিটাগুড়, আটা, ভুট্টা ও ডালের গুড়া মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। কেউ কেউ খেজুর গুড়ের রসে চিনির বস্তা ঢেলে ভেজাল গুড় তৈরির উৎসবে মেতে ওঠে। ভয়ের বিষয় হলো- দেশের প্রায় সব গুড় উৎপাদন এলাকায় গুড়ের রং ক্ষণস্থায়ী সোনালি হলুদ করার জন্য হাইড্রোজ নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ক্ষতিকর মাত্রায় মেশানো হয়। হাইড্রোজের রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। এই রাসায়নিক পদার্থটি পৃথিবীর কোনো দেশেই খাদ্য প্রস্তুত কাজে ব্যবহারে অনুমতিপ্রাপ্ত নয়। এটি কাপড় ও কাগজ কলে বিরঞ্জক হিসেবে ব্যবহার করা হয়- যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
গুড় উৎপাদনে আখ থেকে রস আহরণের জন্য দেশে পশুচালিত, ডিজেলচালিত ও বিদ্যুৎচালিত মাড়াই কল ব্যবহার করা হয়। পশুচালিত মাড়াই কলে তুলনামূলকভাবে রস আহরণ হার বেশি। শতকরা ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ। বর্তমানে গুড় উৎপাদনে ডিজেলচালিত মাড়াই কল বেশি ব্যবহার হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ থেকে ৫৫০ কেজি ইক্ষু মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন এ জাতীয় মাড়াই কলের রস আহরণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ। অন্যদিকে বিদ্যুৎচালিত মাড়াই কলের ঘণ্টায় ৩৫০ থেকে ৪৫০ কেজি পর্যন্ত আখ মাড়াই করা যায় এবং এর রস আহরণ ক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ। এসব মাড়াই কলে আখ একবারই মাড়াই করা হয় ফলে ইক্ষুতে বিদ্যমান চিনির ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ছোবড়াতে থেকে যায়, যা বিরাট অঙ্কের জাতীয় অপচয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসআরআই একটি আধুনিক আখ মাড়াই কল উদ্ভাবন করে। মাড়াই কলটি ঘণ্টায় ৪৫০ থেকে ৫৬০ কেজি আখ মাড়াই করতে পারে এবং এর রস আহরণ ক্ষমতা ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ। মাড়াই কলটির আনুমানিক মূল্য ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতির মতো এই যন্ত্রটিতে শতকরা ৫০ ভাত ভর্তুকি এবং মাড়াই কল ক্রয়ে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গুড় উৎপাদন এলাকায় মাড়াই কলটির বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
আমাদের কথা, গুড়ের ঘাটতি পূরণের জন্য চর ও পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক ভিত্তিতে আখের চাষ করতে হবে। দেশে মিলজোন বহির্ভূত এলাকায় একটি গুড় বোর্ড গঠন করে আখচাষিদের মধ্যে মিল এলাকার মতো ঋণে বিশুদ্ধ বীজ, সার, নগদ অর্থ ও বালাইনাশক বিতরণ করতে হবে। আখচাষিদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে উন্নত মানের আখ মাড়াই যন্ত্র সরবরাহ করতে হবে। মিল এলাকার মতো মুড়ি ও রোপা আখ চাষে সমপরিমাণ ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। গুড় উৎপাদন এলাকায় আর্দ্র-গরম-বাতাস শোষিত পরিচ্ছন্ন ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন এবং বিতরণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বাংলাদেশ বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লি. বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন
netairoy18@yahoo.com