সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৪ পূর্বাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
দ্বিতীয় হিজরির রজব মাসে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সংবাদ পৌঁছে, কোরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া থেকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কায় আসছে। এ সম্পদ মুসলমানদের বিপক্ষে কাজে লাগানোর আশঙ্কা। তাই নবী কারিম (সা.) কাফেলার পিছু ধাওয়া করার আহ্বান জানান। সময় কম থাকায় বড়সড় প্রস্তুতির সুযোগ হয়নি। মাত্র ৩১৩ জন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাদের কাছে ছিল ২টি ঘোড়া ও ৭০টি উট। অস্ত্র হিসাবে ছিল ৬টি লৌহবর্ম ও ৮টি তলোয়ার আর কিছু খেজুরের ঢাল। সাহাবিরা সেই সীমিত বাহনে পালাবদল করে আরোহণ করে চললেন। এ খবর আবু সুফিয়ানের কাছে পৌঁছলে তিনি প্রচন্ড ভয় পান এবং দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় লোক পাঠান।
মক্কায় সংবাদ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আবু জাহেল ১০০০ সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রওনা হয়। তাদের কাছে ছিল ১০০ ঘোড়া ও ৭০০ উট। অস্ত্র হিসেবে ছিল ৬০০ লৌহবর্ম ও হাতে হাতে অসংখ্য তীর-তলোয়ার। সুরাকা বিন মালিকের রূপ ধরে রাস্তায় এসে দলবল নিয়ে যোগ দেয় খোদ শয়তান। খুব বীরত্ব ও অহংকারের সঙ্গে চলতে থাকে। আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে মুসলিমদের সতর্ক করে বলেন, ‘আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বের হয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোক দেখানোর উদ্দেশে।’ -সুরা আনফাল : ৪৭
এদিকে নবী কারিম (সা.)-এর কাছে কোরাইশদের বের হওয়ার সংবাদ পৌঁছলে (যেহেতু পূর্ব থেকে বড় কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না তাই) বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সাহাবাদের নিয়ে পরামর্শে বসেন। মুহাজিরদের মধ্য থেকে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর মতো প্রবীণ সাহাবিরা যুদ্ধের পক্ষে নিজেদের মত তুলে ধরেন। কিন্তু নবী কারিম (সা.)-এর মন ভরে না। তিনি কয়েকবার পরামর্শ চান। তৃতীয়বারে আনসাররা বুঝতে পারেন নবী কারিম (সা.)-এর উদ্দেশ কী। তাই তাদের মধ্য থেকে হজরত সাদ বিন মুয়াজ (রা.) দাঁড়ান এবং বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি সম্ভবত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আপনি যদি আমাদের ঘোড়া ছুটিয়ে সমুদ্রে ঝঁাঁপ দিতে বলেন; আমরা তাই করব। যেখানে যেতে বলেন সেখানেই যাব। এমন কি বারকুল গামাদ (লোহিত সাগরের অপর প্রান্তের একটি অঞ্চলের নাম) পর্যন্ত যেতে বললেও আমরা দ্বিধাবোধ করব না।’ অতঃপর আরেক সাহাবি হজরত মিকদাদ বিন আসওয়াদ (রা.) দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। তিনি বলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা আপনাকে মুসা (আ.)-এর অনুসারীদের মতো কথা বলব না। তারা হজরত মুসা (আ.) কে বলেছিল, ‘আপনি এবং আপনার রব মিলে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব।’ বরং আমরা বলছি, ‘আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে থেকেই যুদ্ধ করব।’ এবার নবী কারিম (সা.)-এর চেহারায় খুশির আভা ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, ‘তাহলে এবার আগে বাড়ো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহতায়ালা আমাকে কাফেরদের দুদলের একটির ওপর বিজয় দানের ওয়াদা করেছেন। আর আমি কাফের নেতাদের নিহত হওয়ার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি।’
চলতে চলতে বদর প্রান্তরে এসে দুই দলের সাক্ষাৎ হয়। সময়টি ছিল গ্রীষ্মকাল। আবার প্রথম রোজার মাস। এর আগে একাধারে মুসলমানরা রোজা রেখেও অভ্যস্ত ছিলেন না। কয়েকদিনের ধারাবাহিক সফর, ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণায় সাহাবিদের মানসিক অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। বদরে যেখানে তারা স্থান নিয়েছিলেন সেটাও ছিল বালুকাময়। অপরদিকে কোরাইশরা স্থান দখল করেছিল সবুজ-শ্যামল ভূমিতে। অতঃপর শুরু হলো রহমতে বৃষ্টি। নবী কারিম (সা.)-এর সাহাবিরা ওই বৃষ্টিতে ভিজে শীতল পানি পান করে নতুন প্রাণ পায়। রাতে আরামের ঘুম হয়। ধুলোবালু ভিজে শক্ত হয়। আর কোরাইশদের বৃষ্টির কারণে মাটিতে কাদা জমে। রাতভর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
নবী কারিম (সা.) সারারাত জেগে নামাজ পড়েন আর আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান। দুর্বল-অসহায় সাহাবিদের পক্ষে সাহায্য চান। ফজরের নামাজের পর সাহাবাদের নিয়ে দোয়া করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও তিনি দোয়ায় মশগুল ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি যে ওয়াদা করেছিলেন আজ তা পূরণ করুন। ওগো দয়াময়! আজ যদি ইসলামের এই ছোট কাফেলাকে ধ্বংস করেন তাহলে পৃথিবীতে আর কোনোদিন আপনার ইবাদত হবে না।’ আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া কবুল করে অহি পাঠান, ‘স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন তোমরা ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে স্বীয় রবের কাছে, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদ কবুল করে বলেন, ‘আমি তোমাদের সাহায্য করব ধারাবাহিকভাবে আগত এক হাজার ফেরেশতার মাধ্যমে।’ -সুরা আনফাল : ৯
১৭ রমজান, জুমাবার সকালে শুরু হয় যুদ্ধ। দলে দলে আসমান থেকে নেমে আসে ফেরেশতাদল। শয়তান তার দলবল নিয়ে পলায়ন করে। পরাজিত হয় দুশমন। বিজয় লাভ করেন মুমিনরা। কাফেরদের ৭০ জন বন্দি হয়। ৭০ জন নিহত হয়। আবু জাহেল, উতবা ও শায়বার মতো মক্কার বড় বড় কাফের নেতারা প্রাণ হারায়। মুমিনদের শহিদ হন ১৪ জন। এ বিজয়ে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস গাঢ় হয়। আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হন। ঘরে ঘরে আনন্দ জোয়ার বইতে থাকে। আর কাফেররা ভেঙে পড়ে। দুঃখে, ক্ষোভে জ্বলতে থাকে। তাদের ঘরে ঘরে শোকের মাতম নেমে আসে।
ভয়েস/আআ