রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০২ অপরাহ্ন
হোসাইন মোহাম্মদ ইলিয়াস:
শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাতিরে তার উম্মতকে অনেক বৈশিষ্ট্য এবং মর্যাদা দান করা হয়েছে। লাইলাতুল কদর বা শবেকদর তার অন্যতম। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত মহিমান্বিত এ রাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে তা যথাযথভাবে পালনে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হওয়া।
পরিচয় : লাইলুন আরবি শব্দ। অর্থ রাত, রাত্র, রাত্রি, নিশি বা রজনী। কদর অর্থ- মহিমান্বিত, সম্মানিত, মর্যাদাবান, পুণ্যময়, মূল্য, ভাগ্য, তাকদির, নিয়তি, অদৃষ্ট ও পরিমাণ ইত্যাদি। লাইলাতুল কদর অর্থ- মহিমান্বিত রজনী, পুণ্যময় রজনী, ভাগ্য রজনী, মর্যাদাবান রাত, ইত্যাদি। পরিভাষায় লাইলাতুল কদর এমন বরকতময় ও মর্যাদাবান রাত, যা রমজানের শেষ দশ দিনে অবস্থিত, যাতে কোরআনে কারিম অবতীর্ণ হয় এবং যে রাতের ইবাদত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
অবস্থান : চার মাজহাবের আলেমদের অভিমত, মহিমান্বিত এ রাত রমজান মাসেই বিদ্যমান। আল্লাহতায়ালার ভাষায়, ‘এ কোরআন আমি কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।’ -সুরা কদর : ১
অতএব, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, এটা রমজান মাসেই অবস্থিত। তবে রমজান মাসের কোন রাতে এটা বিদ্যমান সে বিষয়ে আলেমদের মধ্যে একাধিক মত পাওয়া যায়। শবেকদর রমজানের শেষ দশ দিনে অবস্থিত, তবে জমহুর (অধিকাংশ) উলামায়ে কেরাম ২৭ রমজানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় আমি সে সম্পর্কে অধিক জানি, যে রাত পালনের জন্য রাসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ করেছেন তা (রমজানের) ২৭তম রাত।’ -সহিহ মুসলিম
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন, অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি/ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে তোমরা তা রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাত্রিতে তালাশ করো।’ -মুুত্তাফাকুন আলাইহি
উপরোক্ত প্রমাণাদির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয়, শবেকদর রমজানের শেষ দশকে বিদ্যমান, আরও একটু সহজ করলে শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহে অবস্থিত। যদিও ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কিন্তু শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহ তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রাতে তালাশ করাই অধিক নিরাপদ।
গোপন রাখার হেকমত : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতেন শবেকদর কোন রাতে। পরে আল্লাহতায়ালা তার স্মৃতি থেকে তা ভুলিয়ে নির্দিষ্ট করে বলা থেকে বিরত রাখেন। হাদিসের ভাষায়, উবাদাতা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারিম (সা.) আমাদের লাইলাতুল কদরের সংবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন, কিন্তু সাহাবিদের মধ্যে দু’জন পরস্পর জোরে শব্দ করছিলেন। তিনি বলেন, আমি তোমাদের লাইলাতুল কদরের খবর দেওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম; কিন্তু অমুক ও অমুকে শোরগোল করছিল, অতঃপর আমার স্মৃতি থেকে তা সরিয়ে নেওয়া হলো। আশা করি এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর।’ -সহিহ বোখারি
আলেমরা লাইলাতুল কদর গোপন রাখার হেকমত সম্পর্কে বলেন-
১. কারা এ মর্যাদাপূর্ণ রাত পেতে সচেষ্ট হয় আর কারা গাফেল থাকে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য এটা এক বিশেষ পরীক্ষা।
২. মানবজাতি এ রাতের গুরুত্ব অনুধাবন করত, তা যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট হবে।
৩. এ মহিমান্বিত রাত তালাশে রোজাদাররা যেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে।
৪. এ সৌভাগ্য রজনী পাওয়ার জন্য একাধিক রাতে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে বান্দা লাভবান হবে।
৫. বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে মহান মনীবের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে।
৬. ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের সম্মানিত করার সুবর্ণ সুযোগ লাভে সচেষ্ট হবে।
শবেকদরের মর্যাদা : লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা এত বেশি, যে কারেণ আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে পরিপূর্ণ একটি সুরা নাজিল করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন মহিমান্বিত রাতে অবতীর্ণ করেছি। এ মহিমান্বিত রাত সম্বন্ধে আপনি কী জানেন? এ মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও জিবারাঈল অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’ -সুরা কদর : ১-৫
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘নিশ্চয়ই এ রাতের নামাজ, জাকাত ও সদকা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘রমজান মাসে রয়েছে এমন এক মহিমান্বিত রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে চিরবঞ্চিত।’ -আহমদ
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা চলে, এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা অনেক বেশি। যে ব্যক্তি রোজা পালনের পাশাপাশি এ রাতে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, দোয়া-
ইস্তেগফারসহ অন্যান্য ইবাদতের মাধমে অতিবাহিত করবে সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়েও অধিক সময় ইবাদত করল। তাই এ সৌভাগ্যময় রাত লাভ করা সব মুমিনের ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা হওয়া উচিত।
করণীয় : লাইলাতুল কদর আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত এ পুণ্যময় ও মহিমান্বিত রাতের প্রত্যেকটা মুহূর্তকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সর্বোচ্চভাবে সচেষ্ট হওয়া। এ রাতের উল্লেখযোগ্য করণীয় হলো-
১. সিয়াম সাধনার পাশাপাশি এ মর্যাদাবান রাতকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা।
২. রমজানের শেষ দশকে এ মহিমান্বিত রাত তালাশ করা।
৩. ফরজ নামাজসমূহ জামাতের সঙ্গে আদায় করা।
৪. তারাবি, নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাহলিল, দোয়া, দরুদ ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত পালন করা।
৫. আল্লাহতায়ালার দরবারে খালেসভাবে তওবা-ইস্তেগফার করা।
৬. পিতা-মাতার অনুগত থাকা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা ও তাদের থেকে দোয়া নেওয়া।
৭. পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয় ও সব মুসলিমের জন্য দোয়া করা।
৮. যাবতীয় হারাম ও অন্যায় কাজ থেকে নিজকে মুক্ত করে নেওয়ার ওয়াদা করা এবং তা পালন করা।
৯. অন্যের হক নষ্ট করলে, আমানতের খেয়ানত করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হক প্রদানের মাধ্যমে মুক্তি লাভের চেষ্টা করা।
১০. অন্যায়ভাবে কাউকে কোনোরূপ কষ্ট দিয়ে থাকলে, তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
১১. পরিবারের সব সদস্যকে রাত জাগরণের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
১২. তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা।
১৩. কোরআনে কারিমের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক গভীর করা, অধিক অধিক তেলাওয়াত করা, বুঝার চেষ্টা করা এবং সে অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করা।
১৪. আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর আদিষ্ট বিষয়গুলোর পরিপূর্ণ প্রতিপালন ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো বর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া।
১৫. কল্যাণ, সফলতা ও মুক্তির লক্ষ্যে বেশি বেশি চেষ্টা করা।
১৬. মহান রবের কাছে বিশেষ রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। হাদিসে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, হে রাসুল! যদি আমি লাইলাতুল কদর জানতে পারি তাহলে তাতে কী বলব? রাসুল (সা.) তার জবাবে বলেন, ‘তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ -জামে তিরমিজি
১৭. এ মহিমান্বিত রাতের অন্বেষণ শুধু ২৭তম রাতে সীমাবদ্ধ না রেখে শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহে তালাশ করা।
ভয়েস/আআ