রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৪ অপরাহ্ন
তাসকিন জাহান:
মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। এই নেয়ামতের শোকরগোজারি করা কর্তব্য। শোকরগোজারির প্রথম ও বড় দিক হচ্ছে, নেয়ামতটি যে দয়াময় আল্লাহর দান এই বিশ্বাস রাখা। মানুষের মেধা, মনন, চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তি মানুষের নিজের সৃষ্টি নয়, তা মহান আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর দান। এই দান স্বীকার করা শোকরগোজারির প্রথম শর্ত।
সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। (তবে) প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ আছে। তোমাকে যা উপকার দেবে সে বিষয়ে লালায়িত হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম অকর্মণ্য হয়ো না। কোনো (অবাঞ্ছিত) বিষয়ে আক্রান্ত হলে বলো না যদি আমি এই করতাম তাহলে এই এই হতো; বরং বলবে, আল্লাহর ফয়সালা; তিনি যা চান তাই করেন। কারণ, ‘যদি’ কথাটা শয়তানের কাজের পথ খুলে দেয়। সহিহ মুসলিম : ২৬৬৪
একটু মন দিয়ে চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, এই হাদিসে মানুষের চিন্তাশক্তি ও কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর কী গভীর শিক্ষা রয়েছে। একই সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণভাবে গোটা বিষয়টি উম্মতের চিন্তা-চেতনায় উপস্থিত করা হয়েছে!
হাদিসের বর্ণিত প্রথম বাক্যে, দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিন শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ আছে। এখানে প্রথমে বুঝতে হবে, ‘দুর্বলতা’ ও ‘সবলতা’র দিকগুলো। হাদিসের ভাষ্যকাররা বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন। একেক জনের আলোচনায় একেকটি দিক উঠে এসেছে।
ইমাম নববি (রহ.) বলেন, শক্তি অর্থ আখেরাতের বিষয়াদিতে উদ্যমী ও কর্মতৎপর স্বভাব। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি দুশমনের সঙ্গে জিহাদে অধিক আগুয়ান হয়, অন্যদের আগে বের হয় ও দ্রুত অগ্রসর হয়। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ক্ষেত্রে এবং এ সব বিষয়ে কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করা ও আল্লাহর জন্য কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করার ব্যাপারে অধিক শক্তি-সাহসের পরিচয় দেয়। নামাজ, রোজা, জিকির-অজিফা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে সে হয় বেশি আগ্রহী ও তা পালনে বেশি তৎপর এবং ধারাবাহিকতা রক্ষায় অধিক সক্ষম ইত্যাদি।
ইমাম নববি (রহ.) যে শক্তির কথা বলেছেন, তা মূলত চিত্ত ও স্বভাবের শক্তি। ভালো কাজে উদ্যম, উদ্দীপনা। এই শক্তির অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে এমন এমন কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন, যা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি দৈহিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব হয় না।
বস্তুত মুমিনের জীবন তো শরিয়তের বিধান অনুসারেই হতে হবে। এটা তার কাছে তার ইমানের দাবি। ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে আয়-উপার্জন, লেনদেন, দাম্পত্য, সামাজিকতা, শিক্ষা-দীক্ষা, পর্ব-উৎসব সব কিছুই আখেরাতের বিষয়াদির প্রশস্ত ক্ষেত্র। কারণ এই সবক্ষেত্রেই আছে শরিয়তের বিধি-বিধান, শিক্ষা ও নির্দেশনা।
তেমনি জীবনের সব অবস্থা- সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-নিরানন্দ ইত্যাদি সবই আখেরাতের বিষয়াদির ক্ষেত্র। এই সব অবস্থার বিশেষ বিধান পালনের মাধ্যমে আখেরাতের সঞ্চয় সমৃদ্ধ হয়।
রোগ-শোক, বিপদাপদ, ভীতি-শঙ্কা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোতেও আছে মুমিনের জন্য বিশ্বাসগত ও কর্মগত নানা নির্দেশনা, যা পালন করা দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ ও সাফল্যের উপায়।
হাদিসে বর্ণিত দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, তবে এদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে কল্যাণ। অর্থাৎ সবল মুমিন ও দুর্বল মুমিন উভয়ই কল্যাণের অধিকারী।
ইমাম নববি (রহ.) বলেন কারণ, উভয়েই ইমানের অধিকারী। তাছাড়া দুর্বল মুমিনও তো বিভিন্ন ইবাদত ও নেক আমল করে থাকেন।
এটি হাদিসের শিক্ষার যথার্থতা ও ভারসাম্যের একটি দৃষ্টান্ত। সবল মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময়ও দুর্বল মুমিনকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে না; বরং তাকেও স্ব-স্থানে রাখা হচ্ছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের শিক্ষা।
কখনো কখনো মুসলিম সমাজে এ রকম দৃষ্টান্ত দেখা যায় যে, মুমিন মুসলমানের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তার ইমানি বৈশিষ্ট্য স্মরণ রাখা হয় না। ব্যক্তি ও সমাজের ত্রুটি থাকে। সে হিসেবে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজের নানাবিধ ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে এটি কেউ অস্বীকার করে না, ইমানি দুর্বলতা ও ইসলামি শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসাই এই দুর্বলতার বড় কারণ, এ কথাও সত্য। কিন্তু সব ত্রুটি-বিচ্যুতি দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনো মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজে ইমানের বদৌলতে যে কল্যাণ রয়েছে তাও একেবারে কম নয়। ন্যায়নিষ্ঠ তুলনায় এই সত্য প্রকাশিত হতে বাধ্য। সর্বোপরি মুমিনের ইমানই তো এমন বৈশিষ্ট্য, যার সঙ্গে অন্যকোনো বৈশিষ্ট্যের তুলনা হতে পারে না। এরপর তৃতীয় বাক্যে বলা হয়েছে, ‘যা কিছু তোমাকে উপকৃত করে তার ব্যাপারে লালায়িত হও। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো। অক্ষম হয়ো না।’
হাদিসে ‘উপকারী সব বিষয়ে’ আগ্রহী হওয়ার, শুধু আগ্রহী হওয়া নয়; বরং লালায়িত হওয়ার আদেশ করেছে।
প্রশ্ন হলো- উপকারী বিষয় কী? মুমিনের কাছে উপকারী বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ। উপকার-অপকারেরও তার রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। মুমিনের কাছে ওই বস্তু ও বিষয়ই উপকারী, যা আল্লাহর আনুগত্যের অনুসারে হয়। আল্লাহর নাফরমানির দ্বারা পার্থিব কোনো উপকার হাসিল হলেও বাস্তবে সেটা উপকার নয়।
ইসলাম যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত দ্বীন, তাই ইসলামের শিক্ষা মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে বিস্তৃত। জীবনের সব প্রয়োজন পূরণের এবং সব কল্যাণ অর্জনের অবকাশ ইসলামে আছে, যদি বাস্তবেই তা প্রয়োজন হয় এবং কল্যাণের বিষয় হয়।
ইসলামের এই সমগ্র শিক্ষাটি স্মরণে রেখে যদি অন্যান্য মতবাদের কর্ম-তৎপরতার শিক্ষাকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে সেসব চিন্তা-দর্শনের খন্ডিত ও প্রান্তিকতাপূর্ণ হওয়া দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন মানুষকে যদি শুধু কর্ম-তৎপর হতে বলা হয়, কিন্তু কর্ম ও তৎপরতায় বৈধ-অবৈধের বাছ-বিচারের চেতনা দান না করা হয়, কিংবা বৈধ-অবৈধের ক্ষেত্র ও বিধান না শেখানো হয় তাহলে এই কর্মতৎপরতার শিক্ষাই কি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য নানাবিধ সঙ্কট তৈরি করবে না?
বর্ণিত হাদিসে আমরা দেখতে পেলাম, ইসলাম আমাদের কত গুরুত্বের সঙ্গে ভালো কাজে ও ভালো বিষয়ে উৎসাহিত হওয়ার নির্দেশনা দান করেছে! দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী বিষয়াদিতে কর্মতৎপর হওয়ার কী বাস্তবসম্মত শিক্ষা দান করেছে! ইসলামের এই শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে আমরা যদি তার যথার্থ অনুসরণ করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ দ্বীন-দুনিয়ার সফলতা অর্জনে আমরা সক্ষম হব।
ভয়েস/আআ