শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৪ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সমস্যা দেশে সমাধান বিদেশে!

রাজেকুজ্জামান রতন:
বাংলাদেশের ব্যাপারে নানা দেশের নানান বক্তব্য ও তৎপরতা দেখে সেই বহুল প্রচারিত গল্পটাই মনে পড়ে যায়। এক বুড়িমা রাতের বেলা রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কী যেন খুঁজছিলেন। তা দেখে উৎসাহী কয়েকজন জিজ্ঞেস করলেন, কী খুজছ মা? বুড়িমা উত্তর দিয়েছিলেন, টাকা হারিয়ে গিয়েছে বাবা, হারানো টাকা খুঁজছি। উপস্থিত সবাই মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও টাকা যখন পেল না তখন একজন জিজ্ঞেস করেছিল আচ্ছা মা, ঠিক করে বলো তো টাকা কোথায় হারিয়েছ? বুড়িমা অন্ধকারের দিকে আঙুল নির্দেশ করে দেখিয়ে বলেছিল ওই যে, ঐখানে। কথা শুনে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তারা জিজ্ঞেস করেছিল, টাকা হারিয়েছ ওখানে আর খুঁজছ এখানে? বুড়িমায়ের সরল স্বীকারোক্তি, কী করব বাবা, ওখানে যে আলো নেই। দেশের বর্তমান অবস্থাও কি সে রকম?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। নির্বাচন কীভাবে হবে, আদৌ কী হবে, হলে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে না কার অধীনে হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। অতীতের নির্বাচন তো বটেই, নিকট অতীতের অর্থাৎ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথা উল্লিখিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। বিরোধী মতকে দমন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীভূত করা, প্রশাসন ও পুলিশকে রাষ্ট্রীয় নয়, দলীয়ভাবে ব্যবহার করার অভিযোগ অনেক পুরনো। এখন এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার তাদের ভূমিকা ও বক্তব্য দেখে অনেকে দুষ্টামির ছলে বলেন, পুলিশ এবং প্রশাসন কার, ক্ষমতায় যারা থাকবে তার। কিন্তু এতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা যেমন ক্ষুন্ন হয় তেমনি নষ্ট হয় পেশাদারত্ব।

যারা ক্ষমতায় আসেন তারাই প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার করে প্রশাসন যন্ত্রকে। বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ ট্যাক্স দিয়েও সেবা পান না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও যারা ক্ষমতায় আসেন তারা ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেন, যার দৃষ্টান্ত আছে। তাহলে ৬৪ শতাংশ মানুষ তো ক্ষমতাসীন দলকে ভোট দেয়নি কিন্তু তারা নিপীড়ন আতঙ্কে থাকেন। সে কারণেই গণতান্ত্রিক পরিবেশের স্বার্থেই বলা হয়, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু হায়! জনগণ চায় নিরপেক্ষতা কিন্তু পায় কি তা?

আমেরিকার ভিসানীতি নিয়ে যে আশঙ্কা এবং তোলপাড় তাতে অস্থির হয়ে পড়েছে কারা? কিংবা কাদের ওপর এই নীতি প্রয়োগ হবে, এসব নিয়ে আলোচনা চলতে চলতেই জানা গেল একটি ব্যাংকের কর্ণধার কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। এত আলোচনা, মামলা, চার্জশিট কিছুতেই আটকানো গেল না তার বিদেশে যাওয়া। কয়েকদিন আগে দৈনিক ইত্তেফাকে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, বিদেশে টাকা পাচারে আমলাদের সংখ্যাটাই নাকি বেশি। ইত্তেফাকের রিপোর্টে বলা হয়, বিদেশে সম্পদ আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে যাদের সম্পদ আছে এমন ব্যক্তিরাই এখন সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।

তাদের অবস্থা এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, অন্যদিকে সরকারকে সহযোগিতা করা, কোন দিকে যাবেন তারা? যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে এখন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রেখে সরকারকে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। উল্টো সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তৎপরও কেউ কেউ। কারণ তারা সরকার পরিবর্তন হলেই উড়াল দেবেন আমেরিকায়। সব ধরনের ব্যবস্থা তারা করে রেখেছেন।

এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দারা বিদেশে সম্পদ আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ কিনেছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা করছেন। প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিদেশে সম্পদ গড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন আমলারা। এ ছাড়া বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য আছেন। অনেকের স্ত্রী আমেরিকায় নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সন্তানরাও সেখানে পড়াশোনা করছে। তাদের নিজেদের পাসপোর্টেও লম্বা মেয়াদে আমেরিকার ভিসা লাগানো আছে। ফলে ভিসানীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কীভাবে কাজে লাগাবে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে যথেষ্ট। ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রদূতরা ভীষণ ব্যস্ত। প্রায় প্রতিদিনই তারা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে, পত্রিকায় আসছে সেসব কথা ফলাও করে।

আমদানি-রপ্তানি বিশেষ করে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি নিয়ে প্রধান বিবেচনা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ এবং আমেরিকার বাজার। সেখানে কী কোন বিধিনিষেধ আসবে এই প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে। ফলে সেসব দেশের কূটনীতিকরা যখন রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে বিবৃতি দেন তা ব্যবসায়ী মহলে আলোড়ন তোলে। তাদের প্রয়োজন সস্তা পণ্য আর বাংলাদেশের প্রয়োজন রপ্তানি। এই নিয়েই চলে টানাপড়েন। এর মধ্যে আবার চীন এবং রাশিয়ার মন্তব্য পালে নতুন হাওয়া দিয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও নাক গলানো তারা নাকি পছন্দ করবেন না। ফলে নির্বাচন বাংলাদেশে আর আলোচনা চলছে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশে দেশে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কি বাংলাদেশের গণতন্ত্র খুঁজে দেওয়া? এভাবে আশা করলে দুঃখ পেতে হবে। বিগত সরকারগুলোর সময়ে তাদের ভূমিকা দেখলে কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দেখলেও ধারণা পেতে অসুবিধা হবে না।

সরকার যেই হোক না কেন, তাদের লক্ষ্য বাণিজ্য, সস্তা শ্রমশক্তি, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, কোন প্রভাব বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশকে আটকে রাখা যাবে এই বিষয়টাই মুখ্য। চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি যেমন বিশাল তেমনি বাংলাদেশের ওপর তাদের রাজনৈতিক প্রভাব কেমন সেটাও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার নীতি যেখানে চীন ঠেকাও আর চীনের নীতি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াও সেখানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি খুব জায়গা পাবে কি? জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা আর নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদেশিদের জন্য খুব বেশি ভাবনার বিষয় কখনই ছিল না।

রাশিয়া যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার নিজের প্রভাব বলয় বাড়ানোর জন্য সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার মনোভাবটা বিবেচনাযোগ্য। চীন এবং রাশিয়ার সম্পর্কটা বিশ্বরাজনীতিতে কিছুটা প্রভাব ফেলছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের শেষে চীন ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। এই পরিমাণটা অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি অথবা ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, তার থেকে অনেক বড়। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্য ৬৮ শতাংশ, তুরস্কের সঙ্গে ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্য বেড়েছে ২০৫ শতাংশ।

বিশ^ অর্থনীতিতে এশিয়া ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ২০২১ সালে এশিয়ার অর্থনীতি ছিল বৈশ্বিক জিডিপির ৩৯ শতাংশ। মহাদেশগত জিডিপির হিসাবে এশিয়া এখন বৃহত্তম। বৈশ্বিক রপ্তানির ৩৬ শতাংশ এখন এশিয়া থেকে হয়। চীন ও হংকং, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারত এশিয়ার বৃহত্তম পাঁচ অর্থনীতি বৈশ্বিক আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি করে থাকে।

অর্থনীতির গতিপ্রবাহ দেখলে ২০২২ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব অর্থনীতির ভারকেন্দ্র এশিয়ামুখী করে তুলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে স্বল্প সময়ের জন্য অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও রাশিয়া তাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাণিজ্যের বেশির ভাগটাই এশিয়ায় পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এশিয়া এখন রাশিয়ান পণ্যের বিকল্প রপ্তানি গন্তব্য এবং একই সঙ্গে আমদানির নতুন উৎস। চীন, ভারত, তুরস্ক, উপসাগরীয় ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এখন রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে।

২০২২ সালে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৯ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে এসে সেটা ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। চীন ও রাশিয়া তাই তাদের রাজনৈতিক মিত্র খোঁজার চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশ তাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশিদের যে তৎপরতা তা বহুদিক থেকেই বিবেচনায় রাখতে হবে। যে কোনো দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন করতে হয় দেশের জনগণকে নিয়েই। রাজনৈতিক আন্দোলন তো শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য নয়, রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও বটে।

নির্বাচন এলে যে টাকার খেলা, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয় তা বন্ধ করতে না পারলে নির্বাচনে যে দলই জিতে ক্ষমতায় আসুক না কেন, গণতন্ত্রের চর্চা কি করা সম্ভব হবে? বাজেটে আয় করা হবে জনগণের কোন অংশের কাছ থেকে আর বরাদ্দ করা হবে কোন অংশের জন্য কতটুকু, তা যদি রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয় না হয়, তাহলে জনগণের জন্য বাজেট প্রণয়ন করার দায় অনুভূত হবে কীভাবে? শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের বিষয় তো রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হতে হবে। বিদেশিদের কী দায় পড়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর? তারা মাথা ততটুকুই ঘামাবে এবং তাদের নাক সেখানেই গলাবে যেখানে তাদের স্বার্থ লুকিয়ে আছে। সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন কি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে, যদি সরকার সহায়তা না করে?

একজন মেয়রপ্রার্থী আক্রান্ত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মন্তব্য করেন আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে তখন তার নিরপেক্ষতাই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ হয় না, দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেন। ফলে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে।

যেখানে ভাবনার কেন্দ্রে শুধুই ক্ষমতা জনগণের অবস্থান শূন্যের কোঠায়, যেখানে ক্ষমতা ও দুর্নীতি একে অপরের পরিপূরক, সেখানে বিদেশিরা কর্র্তৃত্ব করার সুযোগ পেলে ছাড়বে কেন? সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সহায়তা নিয়ে কোনো দেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে এমন নজির কম। বরং তারা বিশ্বের দেশে দেশে লুণ্ঠন ও অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সে কথা যেন ভুলে না যায়।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট

rratan.spb@gmail.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION