বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৮ অপরাহ্ন
ক্যারোলাইন ডেভিস:
কয়েক মাসের মধ্যে ইমরান খান দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হলেন, কিন্তু এবারের প্রতিক্রিয়া একেবারেই আলাদা। এই বছরের ৯ মে এবং গত ৫ আগস্টের মধ্যে যে বিশাল বৈপরীত্য দেখা গেল তা বিস্ময়কর বললেও যেন কম বলা হয়। ইমরান খানের প্রথমদফা গ্রেপ্তারের ফলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাস্তায় নামা নেতাকর্মী-সমর্থকের মুখে ছিল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেøাগান। কিন্তু গত শনিবারের রাত পাকিস্তানের আর দশটা সাধারণ রাত থেকে আলাদা কিছু ছিল না। রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করে অর্জিত অর্থ নিয়মমতো ঘোষণা না করার অপরাধে তিন বছরের সাজা পেয়ে ইমরান খান এখন কুখ্যাত অ্যাটক জেলে। মনে করা হচ্ছে এই সাজা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য করবে পিটিআই চেয়ারম্যানকে।
একদা ইমরান ও সেনাবাহিনীর মাখামাখি ছিল সবার জানা বিষয়। ব্যাপকভাবে মনে করা হয়, সাবেক তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে নামা ইমরানকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিল সেনাবাহিনীই। ৯ মে সমর্থকদের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবনসহ নানা সামরিক স্থাপনায় হামলার পর দুপক্ষের সম্পর্কের তিক্ততা চরমে ওঠে। সহিংসতার দায়ে এখন সরকার দমন অভিযান চালাচ্ছে পিটিআই-এর ওপর। চাপের মুখে দলত্যাগ, ভাঙন ধরপাকড়ে দলটির এখন লেজেগোবরে অবস্থা। গ্রেপ্তারের আগে আগে একটি ভিডিওতে জনগণকে বাড়িতে চুপচাপ বসে না থেকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ইমরান। সে আহ্বান কাজ করেনি। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নই এখন অনেকের মুখে মুখে। সিরকারি লোকজন বলবে, এর কারণ হচ্ছে জনগণ আর ইমরান খান বা তার দল পিটিআই-এর সঙ্গে থাকতে চায় না। সহিংসতার জন্য দায়ী একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না তারা। কিন্তু ইমরানের সমর্থকদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে ঠিক উল্টো বার্তা।
‘এস্টাবলিশমেন্টের’ সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্ক (রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পাকিস্তানে এ নামেই পরিচিত) বিষিয়ে যাওয়া শুরু হয় এক বছরেরও বেশি আগে। বিশ্লেষকরা ব্যাপকভাবে মনে করেন, তিনি এস্টাবলিশমেন্টের সহায়তায়ই ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই সম্পর্কের অবনতি হলে তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন। পাকিস্তানের কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বিবিসিকে বলেছে, গত মে মাসের শেষের দিকে টিভি চ্যানেল মালিকদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বৈঠক হয়। এর পর থেকে টিভি সাংবাদিকদের আর ইমরান খানের নাম বলতে, তার ছবি দেখাতে বা এমনকি টিকারটেপে (টিভি পর্দার নিচের শিরোনামের লাইন) তা লিখতে দেওয়া হয়নি।
একসময়ের অনেক সোচ্চার সমর্থক বলছেন, তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় পিটিআই বা এর নেতা সম্পর্কে পোস্ট করা তো বন্ধ করে দিয়েছেনই; অনেক পুরনো পোস্ট মুছে দিয়েছেন। নজরদারির ভয়ে তারা ইমরানের ভাষণের ভিডিও-ও আর দেখছেন না। সরকার বলেছে, তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করছে না। তবে সাংবাদিকরা ইমরানের এবারের গ্রেপ্তারের দিন বিকেলে লাহোরের বাড়ির বাইরে জড়ো হওয়া পিটিআই সমর্থকদের তুলে নিতে দেখেছেন পুলিশকে। তবে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কি না তা ওই সময় জানা যায়নি।
ওয়াশিংটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি কঠোর দমন-পীড়ন ইমরান খানের সমর্থকদের ভীতসন্ত্রস্ত করেছে। আমার মনে হয় ৯ মে ইমরানের পক্ষে সমর্থনের যে জোয়ার দেখা গিয়েছিল সেভাবে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলতে আর ইচ্ছুক নন কেউ।’ কুগেলম্যানের মতে, সামরিক বাহিনীর দিক থেকে দেখলে তারা ঠিক কৌশলই প্রয়োগ করেছে। তারা আগেই কঠোর কৌশল ব্যবহার করে ইমরান সমর্থকদের বৃহত্তর ও আরও জোরদার প্রতিক্রিয়া ঠেকিয়ে দিয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ইমরান খানের আইনজীবীরা বারবার বিভিন্ন আদালত থেকে কিছু সাময়িক স্বস্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন। আরও গুরুতর কিছু মামলা বন্ধ করার পরিবর্তে শুধু বিলম্বিত করা সম্ভব হয়েছে এর ফলে। সেই স্বস্তি আর অব্যাহত থাকবে কি না তা স্পষ্ট নয়। মে মাসে ইমরানের গ্রেপ্তার নাটকীয়ভাবে উল্টে গিয়েছিল। কিন্তু সেবারের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আদালতের কাঠগড়ায় ওঠা বেশ কয়েকজন সাবেক পাকিস্তানি নেতার অন্যতম ইমরান খান। তালিকায় আরও রয়েছেন নওয়াজ শরিফ, বেনজির ভুট্টো ও সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফসহ অনেকে। ইমরান নিজেও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কয়েকজনকে কারাগারে পাঠান। অনেকের আশঙ্কা সত্যি হয়ে মামলার জেরে ইমরান খান সরকারি পদের অযোগ্য ঘোষিত হলে তার দলের কী হবে তা এক বড় প্রশ্ন। ইমরান এর আগে বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হতে পারুন আর না-ই, পিটিআই টিকে থাকবে এবং এগিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি নিশ্চিত করে বলা খুবই কঠিন।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী বড় প্রশ্নটি হলো পিটিআই-এর অবশিষ্ট নেতৃত্ব কীভাবে আবার একজোট হয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন? তারা কি তাদের সমর্থকদের রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করবেন। করলে তা কি সফল হবে? এটা একটা ভালো পরীক্ষা হবে দলটির অবস্থা বোঝার জন্য।’
পিটিআই এমন একটি দল যা কার্যত ইমরান খানের একক উদ্যোগে গঠিত। এটি তাকে কেন্দ্র করেই চলে। এমনকি ব্যালট পেপারে দলটির প্রতীক একটি ক্রিকেট ব্যাট যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে ইমরানেরই অতীত ক্যারিয়ারের চিহ্ন। এ বছরের শুরুর দিকে ইমরান খানকে ঘিরে থাকা অনেক জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার দল ছেড়ে চলে গেছেন। দলের সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছেন। এর কোনোটিই বলে না যে পিটিআই-এর পক্ষে কার্যকর রাজনৈতিক প্রচার চালানো সহজ হবে।
লেখক : বিবিসি নিউজের পাকিস্তান সংবাদদাতা/বিবিসি অনলাইন থেকে ভাষান্তর আবু ইউসুফ
ভয়েস/আআ